বাঙালি জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ও বিকাশধারা আলােচনা কর।
১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান বিভক্তির পর পাকিস্তান নামে যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় তার দুটি অংশ ছিল. (ক) পূর্ব পাকিস্তান ও (খ) পশ্চিম পাকিস্তান। শুরু থেকেই কায়েদে আজম মােহাম্মদ আলী জিন্নাহসহ মুসলিম লীগের কিছু নেতা সুকৌশলে সমৃদ্ধিশালী পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশে পরিণত করার প্রয়াসে লিপ্ত হন।
অল্প দিনের মধ্যেই তাদের পরিকল্পনা পূর্ববাংলার মানুষের চোখে ধরা পড়ে এবং বাঙালিরা তার উপযুক্ত জবাব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। ফলে পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রতিক্রিয়াতেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়।
বাঙালি জাতীয়তাবাদ উদ্ভবের পটভূমি
বাঙালি জাতীয়তাবাদের উদ্ভবের পিছনে বংশগত ও ভাষাগত ঐক্য, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ঐক্য, ধর্মীয় ঐক্য, ভৌগােলিক নৈকট্য, ধ্যান-ধারণা ও চিন্তাগত ঐক্য প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন সুদীর্ঘ কালের ঔপনিবেশিক শাসন ও শােষণ এর বিরুদ্ধে সংগঠিত বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রাম বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশের পথকে করেছে সুসংগঠিত।
সুনির্দিষ্টভাবে বললে ১৯৪০ সালের লাহাের প্রস্তাবে উত্থাপিত এতদ অঞ্চলের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনের দাবি বাঙালি জাতীয়তাবাদ গঠনে সূচনা পর্ব হিসেবে ভূমিকা পালন করে। পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে দুই খণ্ডে বিভক্ত পাকিস্তান রাষ্ট্র বাঙালির জাতীয়তাবাদী চিন্তার বিকাশে নতুন মাত্রার সংযােজন করে। পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলার) জনগণ নতুন আশায় বুক বাঁধলেও অচিরেই তাদের এই আশা গুড়েবালিতে পরিণত হয়।
পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর বৈষম্যমূলক আচরণ ও কার্যক্রম বাঙালিদের নতুনভাবে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই চেতনা নতুন পথে মােড় নেয় এবং পরবর্তীতে ১৯৬৬ সালে ছয়দফা, '৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, '৭০ এর নির্বাচন এবং সর্বশেষে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ পরিপূর্ণতা লাভ করে।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ও বিকাশ
নিম্নে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে আলােচনা করা হলাে :
১. ভাষা আন্দোলনের ভূমিকা: ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন জনগণের মাঝে এক জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটায় এবং ক্রমে তা বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয়। মূলত ১৯৫২ সালের আন্দোলনের মধ্য দিয়েই ছাত্র-জনতা যে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূচনা করে তা ক্রমে শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
২. ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচন: মুসলিম লীগের রাজনৈতিক নিপীড়ন এবং পূর্ববাংলার প্রতি অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রেক্ষাপটে ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। মূলত ১৯৫৪ সালের মুসলিম লীগকে মােকাবিলা করার জন্য বিরােধী রাজনৈতিক দলগুলাে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। শহীদ সােহরাওয়ার্দী ও মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, এ কে ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টি, হাজী দানেশের গণতন্ত্রী পার্টি এবং মওলানা আতাহার আলীর নেজামে ইসলাম দলের সমন্বয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়েছিল। পূর্ববাংলার জনগণের আশাআকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপদানের জন্য যুক্তফ্রন্ট ২১ দফাভিত্তিক নির্বাচনি ইশতেহার প্রণয়ন করে। ২১ দফার প্রধান বিষয়বস্তু ছিল বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা, জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ, পর্ব পাকিস্তানে শিল্প-কারখানা গড়ে তােলা, ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস ঘােষণা করা ইত্যাদি। এ নির্বাচনে ৩০৯টি অসিনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২৩৬টি আসন এবং ৯৭ শতাংশেরও বেশি ভােট পেয়েছিল। অর্থাৎ এ নির্বাচনে পূর্ববাংলার জনগণ বাংলা ভাষা ও স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে রায় দেয়।
৩. জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ও শিক্ষা আন্দোলন : আইয়ুব খান ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে গ্রেপ্তার করেন। তার গ্রেফতারের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ধর্মঘট ও বিক্ষোভের কারণে সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘােষণা করে এবং শেখ মুজিবুর রহমান, তফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়া এবং মনসুর আহমেদকে গ্রেপ্তার করে। এতে ছাত্র আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৬২ সালের ১৯ আগস্ট সরকার সােহরাওয়ার্দীকে মুক্তি দেওয়ার পর পর ছাত্ররা হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের রিপোের্ট বাতিলের আন্দোলন শুরু করে। এ রিপাের্ট বাতিলের পর ১৭ সেপ্টেম্বর ছাত্র বিক্ষোভকালে পুলিশের গুলিতে কয়েকটি তাজা প্রাণ ঝরে পড়ে এবং ৭ অক্টোবর সােহরাওয়ার্দীর আহ্বানে সমগ্র পাকিস্তানে প্রতিবাদ দিবস পালিত হয় ।
৪. ছয়দফা আন্দোলন ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ : ১৯৬৬ সালে পাক-ভারত যুদ্ধ বাঙালি জাতিকে এমন একটি ধারণা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে যে পাকিস্তানিরা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য শুধু বাঙালিদের ব্যবহার করবে। ফলে ১৯৬৬ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি লাহােরে এক সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা দাবি সংবলিত ছয়দফাভিত্তিক এক কর্মসূচি ঘােষণা করেন, যা বাঙালি জাতির স্বাধিকার আন্দোলনের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
৫. ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান : দমননীতির মাধ্যমে ছয়দফা আন্দোলনকে নস্যাৎ করতে না পেরে সরকার বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। ১৯৬৮ সালের ১৯ জুন থেকে ৩৫ জনকে আসামি করে রাষ্ট্রদ্রোহিতার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামক মিথ্যা মামলা দায়ের করে তাদের ওপর অমানুসিক অত্যাচার চালানাে হয়। যার প্রধান আসামি ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ফলে ছাত্ররা ১১ দফা ঘােষণা করে। অবশেষে মামলা প্রত্যাহার করা হয়। ১১ দফা উপেক্ষিত হলে ১৯৬৯ সালে সারা দেশে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। সরকার এ আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে। ছাত্ররা এ ধারা অমান্য করে রাস্তায় নেমে আসে এবং প্রচণ্ড বিক্ষোভ শুরু করে। পুলিশ ছাত্রদের মিছিলের ওপর গুলি চালালে আসাদসহ। বহু সাধারণ মানুষ নিহত হয়। ফলে আন্দোলন আরাে তীব্র আকার ধারণ করে এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দল মৌলিক অধিকার। আদায়ের শপথ নিয়ে আটদফা কর্মসূচির ভিত্তিতে ‘গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। ফলে আইয়ুব সরকারের পতন ঘটে। যা বাঙালি জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ও বিকাশের পথ প্রশস্ত করে ।
৬. ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন : সামরিক শাসক আইয়ুব খানের পতনের পর ক্ষমতায় আসেন জেনারেল ইয়াহিয়া। তিনি জাতীয় পরিষদের নির্বাচন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। ৭ ডিসেম্বর, ১৯৭০ জাতীয় পরিষদের এবং ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন সম্পন্ন হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে। পূর্ববাংলায় ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮২টি আসন আওয়ামী লীগ লাভ করে। ফলে আওয়ামী লীগ একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং বাঙালি জাতি প্রথমবারের মতাে স্বশাসন ও আত্মপ্রকাশ করার সুযােগ লাভ করে। তাই এ নির্বাচন বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৭. ৭ই মার্চের ভাষণ : ১৯৭১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি শেখ মজিবুর রহমান প্রেসিডেন্টকে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকার জন্য পরামর্শ দেন। কিন্তু ভুট্টোর কথা মতাে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ অধিবেশন ডাকেন এবং হঠাৎ করে ১ মার্চ তা বন্ধ করে দেন। এতে জনগণ ক্ষুব্ধ হয়ে অসহযােগ আন্দোলন শুরু করে। অবশেষে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন, ডাকেন। অন্যদিকে, শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চের ভাষণে চারদফা দাবি পেশ করেন (সামরিক শাসন প্রত্যাহার, সামরিকবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া, সামরিকবাহিনীর হাতে প্রাণহানির তদন্ত এবং অধিবেশনের পূর্বে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর)। এই ঐতিহাসিক ভাষণ জাতীয়তাবাদের বিকাশে গুরুত্বপর্ণ অবদান রাখে।
৮. ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা : দেশের বাস্তব সার্বভৌমত্ব যখন জনগণের হাতে, এমন সময় ইয়াহিয়া খান পরিকল্পনা মতাে ১৫ মার্চ ঢাকায় আসেন। ১৬ মার্চ শেখ মুজিবের সাথে তারা বৈঠকে বসেন। ভুট্টো ছয়দফা সংশােধন এবং ক্ষমতার অংশীদারিত্ব দাবি করেন। ক্রমশ পরিস্থিতি জটিল হতে থাকে।আলােচনার নামে কালক্ষেপণ করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য ও রসদ নিয়ে আসাই ছিল পাকিস্তানি শাসকদের উদ্দেশ্য। নেতৃবৃন্দের আহ্বানে চট্টগ্রামে জাহাজ থেকে অস্ত্র নামাতে শ্রমিকরা অস্বীকার করে। ২৪ মার্চ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ সংকট সমাধানের লক্ষ্যে শেষ চেষ্টা করেন। ইয়াহিয়া খানের সাথে দুই ঘণ্টা আলােচনা করেও শেষরক্ষা হয়নি। ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে সামরিকবাহিনীকে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর আক্রমণ চালানাের নির্দেশ দেন। ফলে শুরু হয় নির্মম অভিযান। ঐ রাতে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানে নেওয়া হয়। ফলে শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে বাংলাদেশের সব শ্রেণি পেশার মানুষ ঝাপিয়ে পড়ে শত্রু নিধন করে স্বাধীনতার আশায়। দীর্ঘ নয় মাসের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকশিত হয় বাঙালি জাতীয়তাবাদের চূড়ান্ত অধ্যায় তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মানচিত্রে যে নতুন দেশের অভ্যাদয় হয় তার পেছনে ছিল সুদীর্ঘ ইতিহাস। দুই শ বছর ব্রিটিশ এবং পরবর্তীকালে ২৪ বছর পাকিস্তানি উপনিবেশিক শাসন ও শোষণের ফলে এ দেশের জনগণের মধ্যে ধীরে ধীরে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উদ্ভব হয়, তা-ই পরিপূর্ণ রূপ লাভ করে একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে। বিভিন্ন সময় সংঘটিত বিভিন্ন আন্দোলনই মূলত গড়ে তুলেছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ।