রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসের মধ্যে সম্পর্ক আলোচনা কর।



ইতিহাসের সাথে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সম্পর্ক আলোচনা কর | রাষ্ট্রবিজ্ঞান ছাড়া ইতিহাসের আলোচনা নিষ্ফল আলোচনা কর | রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সঙ্গে ইতিহাসের কি সম্পর্ক আলোচনা কর | ইতিহাস ব্যতীত রাষ্ট্রবিজ্ঞান ভিত্তিহীন- এই উক্তিটি আলোচনা কর | রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাথে ইতিহাসের সম্পর্ক আলোচনা কর | Discuss The Relationship of History with Political Science.


ইতিহাস হচ্ছে মানব সভ্যতার দর্পন। ইতিহাসের পাতা থেকে মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি বহুবিধ বিষয় সম্পর্কে আমরা জানতে পারি। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞান ইতিহাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। অধ্যাপক স্যার জন সিপি সুন্দরভাবে বলেছেন, "রাষ্ট্রবিজ্ঞান ছাড়া ইতিহাসের আলোচনা নিষ্ফল এবং ইতিহাস ব্যতীত রাষ্ট্র বিজ্ঞান ভিত্তিহীন (History without political science has no fruit and political science without history has no root). উইলোবী যথার্থই বলেছেন, "ইতিহাসই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গভীরত্ব দান করেছে” (History provides the third dimension of political science)। ঐতিহাসিক তথ্যের উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব গড়ে উঠেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ইতিহাসের দ্বারা স্ফীবিত। 

রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের সংগঠন এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ইতিহাসের বিবর্তনের দ্বারাই সৃষ্ট হয়েছে। আধুনিক রাষ্ট্র, জাতি ও সরকারের পেছনে রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। লর্ড অ্যাক্ট্রন যথার্থই বলেছেন, “ইতিহাসের স্রোতধারায় বালুকারাশির মধ্যে স্বর্ণরেণুর মত রাজনীতি বিজ্ঞান জমে উঠেছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান শুধু ইতিহাসের নিকট ঋণী নয়, ইতিহাসও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের নিকট ঋণী। বিজ্ঞানী লিকক বলেন, ইতিহাসের অনেকখানি রাষ্ট্রবিজ্ঞানেই এবং বিষয়বস্তু পরস্পরের পরিধি দ্বারা আবদ্ধ। রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্রের আইন ও অন্যান্য নীতি সম্পর্কে ইতিহাসকে অনেক মাল-মসলা যোগান দেয়।"

ইতিহাসের উদ্দেশ্য হল আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। মানব সমাজের রাজনৈতিক ঘটনাবলী ইতিহাসে লিপিবন্ধ আছে। সে অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা বাস্তব সম্মত আদর্শ রাষ্ট্র গঠন করতে পারি। এখানেই ইতিহাসের সার্থকতা নিহিত রয়েছে। অন্যদিকে ইতিহাসও বিজ্ঞান হতে তথ্য সংগ্রহ করে । রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোন থেকে আলোচিত না হলে ইতিহাস সাধারণ ঘটনা, গল্প কথায় পরিণত হবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়গুলো ইতিহাসের দ্বারা যেমন সজীবতা লাভ করে, ঠিক তেমনি ইতিহাসের বিষয়গুলো রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পর্যালোচনা দ্বারা অর্থপূর্ণ হয়ে উঠে। ইতিহাসের দ্বারা মার্জিত ও ব্যাখ্যায়িত না হলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান হয় অসার আর রাজনৈতিক তাৎপর্য হারালে, সে ইতিহাস হয় নিছক সাহিত্য। ইতিহাস ছাড়া রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূল্য নেই। আর রাষ্ট্রবিজ্ঞান ছাড়া ইতিহাসের ফল নেই। সুতরাং বিষয় দুটো একে অপরের উপরে নির্ভরশীল। রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাস উভয়কে যদি পৃথক করে দেওয়া হয়, তাহলে ইতিহাস মৃত না হলেও হবে বিকলাঙ্গ এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান হবে আলেয়ার মত আবছায়াময়। এরা পরস্পর সম্পূরক ও ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কিত।

রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসের মধ্যে গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান থাকলেও বিষয় দুটি স্বতন্ত্র। ঐতিহাসিক ফ্রিম্যান বলেন, “সকল প্রকার ইতিহাসের সঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সম্পর্ক নেই। স্থাপত্য বিদ্যা, শিল্পকলা ও মুদ্রার ক্রমবিকাশের ইতহাসের সঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তেমন একটা সম্পর্কে নেই। রাজনীতি বা রাষ্ট্রতত্ত্ব শুধুমাত্র ইতিহাসের ভিত্তিতে গড়ে উঠেনি। এর মূলে অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব, মনোবিজ্ঞান, আইনশাস্ত্র ইত্যাদি বিষয়ের অনেক উপাদান রয়েছে। ইতিহাস তথ্য ও ঘটনা নির্ভর। ইতিহাস শিক্ষা দেয়, ভবিষ্যতবাণী করে না। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞান অতীত ও বর্তমানের আলোকে ভবিষ্যতবাণী করে। ঐতিহাসিক তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে অতীত ও বর্তমান সমাজ জীবনের মধ্যে ভাল মন্দ বিচার করা যায়। ঐতিহাসিক পটভূমির সাহায্যে বর্তমান সমাজের স্বরূপ উপলব্ধি করা যায়। ঐতিহাসিক তথ্য যে পরিমাণে সংগৃহীত হবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আলোচনা তত সুন্দর ও আকর্ষণীয় হবে। লর্ড ব্রাইস চমৎকারভাবে বলেছেন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস ও রাজনীতি অতীত ও বর্তমানের মাঝে দণ্ডায়মান"।

ইতিহাসের ক্রমবিবর্তনের ধারায় রাষ্ট্র, জাতি ও সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ঐতিহাসিক তথ্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব গড়ে উঠেছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ইতিহাস থেকে শুধু সেই সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করেন যা রাজনৈতিক জীবন গঠনে সহায়তা করে। সার্বিকভাবে ইতিহাস আলোচনা করতে গেলে রাষ্ট্রনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে ইতিহাস আলোচনা করা প্রয়োজন। অনুরূপভাবে ঐতিহাসিক ঘটনায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সঠিক আলোচনা করা প্রয়োজন। রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাস একে অন্যের সম্পূরক।


পূর্ববর্তী পরবর্তী
No Comment
মন্তব্য করুন
comment url