রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত ঐশ্বরিক মতবাদটি সমালোচনাসহ আলোচনা করো

সম্পর্কিত আরো কিছু প্রশ্ন
• ঐশ্বরিক মতবাদ কি? 
• ঐশ্বরিক মতবাদ কাকে বলে?
• ঐশ্বরিক মতবাদ সম্পর্কে আলোচনা করুন।
• ঐশ্বরিক মতবাদের মূল কথা কি?
• রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত ঐশ্বরিক মতবাদটি আলোচনা কর।
• প্রাচীনকালে ও মধ্যযুগে রাষ্ট্রের উৎপত্তিতে ঐশ্বরিক মতবাদের প্রভাব বর্ণনা করুন।
• ঐশ্বরিক মতবাদ রাষ্ট্রকে দৈব প্রতিষ্ঠান বলে মনে করে। বক্তব্যটি সম্প্রসারিত করুন।
• রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে ঐশ্বরিক মতবাদের মূল বক্তব্য সংক্ষেপে আলোচনা করো।
• আপনি কি মনে করেন যে, রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত মতবাদ হিসেবে ঐশ্বরিক মতবাদ অযৌক্তিক এবং অগণতান্ত্রিক? আলোচনা করুন ।

রাষ্ট্রের উৎপত্তি

রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত বিভিন্ন মতবাদ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় এক বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে। যুগে যুগে বিভিন্ন রাজনৈতিক দার্শনিক ও চিন্তাবিদ রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে বিভিন্ন ধারণা পোষণ করেছেন। এর প্রধান কারণ এ বিষয়ে কোন ঐতিহাসিক তথ্য, প্রমাণাদি বা দলিলের অনুপস্থিতি। সঙ্গত কারণেই রাষ্ট্রের সৃষ্টি সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ গড়ে উঠেছে। এসব মতবাদের মধ্য দিয়ে শুধুমাত্র রাষ্ট্রের উৎপত্তিই ব্যাখ্যা করা হয় নি সেই সাথে রাষ্ট্রের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন বিষয় দিকেরও প্রতিফলন ঘটেছে। যেমন এ থেকে সরকার ও জনগণের পারস্পরিক সম্পর্ক, সরকারের রূপ, সার্বভৌম ক্ষমতার অবয়ব এবং এর অবস্থান, শাসক- শাসিতের সম্পর্ক প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কেও ধারণা লাভ করা। সুতরাং বলা যায়, রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত মতবাদগুলোর গুরুত্ব ও তাৎপর্য অত্যধিক।


ঐশ্বরিক মতবাদ কি?

ঐশ্বরিক মতবাদ রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে সর্বাধিক প্রাচীন মতবাদ। ঐশ্বরিক মতবাদের মূল কথা হচ্ছে- রাষ্ট্র ঐশ্বরের সৃষ্টি এবং ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই রাষ্ট্র পরিচালিত। পার্থিব জগতে রাজা হলেন ঈশ্বরের প্রতিনিধি এবং রাজার মাধ্যমেই ঈশ্বরের ইচ্ছা প্রকাশিত হয়। রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা ধর্মদ্রোহিতার শামিল।

এ মতবাদ অনুসারে রাজা তাঁর যাবতীয় কাজের জন্য ঈশ্বরের নিকট দায়ী থাকবেন, প্রজাদের নিকট নয়। ঐশ্বরিক মতবাদ নির্ভর মধ্যযুগীয় রাষ্ট্রগুলোকে তাই বলা হয় ধর্মীয় রাষ্ট্র (Theocratic State) ।

রাষ্ট্র ঈশ্বরের সৃষ্টি এবং পার্থিব জগতে রাজা হলো ঈশ্বরের প্রতিনিধি

ঐশ্বরিক মতবাদের সমর্থন পাওয়া যায় প্রাচীনকালে, মধ্যযুগে এমনকি আধুনিক যুগের প্রথম পর্যায়েও। প্রাচীনকালে ইহুদীরা মনে করত রাষ্ট্র ঈশ্বরের সৃষ্টি এবং ঈশ্বর রাজাকে মনোনয়ন করেছেন। মধ্যযুগেও এই মতবাদের জোর সমর্থন পরিলক্ষিত হয়। সে যুগের চিন্তাবিদ সেন্ট অগাস্টিন, সেন্ট টমাস একুইনাস, জন অব সেলিসবারী অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, রাষ্ট্র ঈশ্বরের সৃষ্টি আর ইহলোকে তাঁর প্রতিনিধি হলেন রাজা। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমস্ এবং তার পুত্র প্রথম চার্লস্ ঐশ্বরিক মতবাদে সমর্থন স্থাপন করে প্রজাদের অধিকার অস্বীকার করেন । ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুই এই মতবাদে যে শুধু বিশ্বাসী ছিলেন তা নয়, তিনি নিজেকে ঈশ্বরের বরপুত্র বলে মতে করতেন। তবে আধুনিককালে রেনেসাঁ বা নবজাগ্রণ, জাতীয়তাবাদ, যুক্তিবাদ ও গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারনার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রের ঐশ্বরিক মতবাদ সংক্রান্ত ধারণা দুর্বল হতে থাকে।

ঐশ্বরিক মতবদের সমালোচনা:

• বলা হয় যে, এই মতবাদ রাজতন্ত্রের মুখপাত্র। এটি রাজন্ত্রের প্রতি অধিক মাত্রায় শ্রদ্ধাশীল। ঈশ্বরের সত্যিকার প্রতিনিধি কে? এ প্রশ্নের উত্তর ঐশ্বরিক মতবাদে পাওয়া যায় না।

• এ মতবাদ অযৌক্তিক। এতে বিশ্বাসের উপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়, যুক্তির উপর নয় । 

• এ মতবাদ অগণতান্ত্রিক, কেননা এতে ঈশ্বরই সকল ক্ষমতার অধিকারী এবং শাসক হিসেবে রাজা তাঁর প্রতিনিধি মাত্র। শাসক তাঁর সকল কাজের জন্য ঈশ্বরের নিকট দায়বদ্ধ থাকবেন, জনগণের নিকট নয়। কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শাসককে জনগণের নিকট দায়বদ্ধ থাকার ব্যাবস্থা করা হয়। কাজেই রাষ্ট্রের উৎপত্তির ঐশ্বরিক মতবাদ সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক।

• ঐশ্বরিক মতবাদ রাষ্ট্রকে এক প্রকার দৈব প্রতিষ্ঠান বলে মনে করে। কিন্তু বাস্তবে রাষ্ট্র হচ্ছে মানবীয় প্রতিষ্ঠান। ঈশ্বর বিশ্বকে সৃষ্টি করেছেন কিন্তু রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানের স্রষ্টা হচ্ছে মানুষ। আর মানুষ রাষ্ট্রীয় সংগঠন তৈরী করেছে তাদের পার্থিব প্রয়োজন মেটাবার জন্য।

• এ মতবাদ দ্বন্দ্ব কলহের সৃষ্টি করে। প্রচীনকালে গ্রীক ও রোমানদের দ্বারা এ মতবাদ প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। মধ্যযুগে এ মতবাদ পোপ ও সম্রাটের মধ্যে বিরোধের সৃষ্টি করেছে। কাজেই এ মতবাদ যে প্রতিক্রিয়াশীল (Reactionary) তা বলাই বাহুল্য।

ঐশ্বরিক মতবদের গুরুত্ব ও প্রভাব

আধুনিকালে ঐশ্বরিক মতবাদকে অগণতান্ত্রিক, অযৌক্তিক, প্রতিক্রিয়াশীল বলে সমালোচনা করা সত্ত্বেও এর যে একেবারে কোন গুরুত্ব ব প্রভাব নেই তা বলা যায় না। বিশেষ করে প্রাচীন ও মধ্যযুগে এ মতবাদের গুরুত্ব ও প্রভাব যথেষ্ট পরিমাণে পরিদৃষ্ট হয়। অজ্ঞতা ও অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে আইন- শৃঙ্খলার প্রতি শাসক ও শাসিত শ্রেণীর মধ্যে কিছুটা পরিমাণে হলেও শ্রদ্ধাবোধ জন্যে। অনেক স্বৈরাচারী শাসককে এ মতবাদ ধর্মীয় অনুশাসনের দিকে অনুপ্রাণিত করে। ফলে তাঁরা রাষ্ট্র শাসনে সে অনুশাসন মেনে চলতে অভ্যস্ত হয়। সুষ্ঠভাবে রাষ্ট্রীয় শাসন পরিচালনার জন্য জনগণের মধ্যে এ মতবাদ ঐক্যবোধের প্রয়োজন শেখায়। সর্বোপরি ঐশ্বরিক মতবাদের ফল হিসেবে মধ্যযুগে রাষ্ট্র-গীর্জার মধ্যে যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় তার অবসানে শেষ পর্যন্ত পরোক্ষভাবে হলেও আধুনিক জাতীয় রাষ্ট্র ও ধর্মনিপেক্ষতার বিজয় সূচিত হয়।

শেষকথা 

রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে ঐশ্বরিক মতবাদের মূল কথা হচ্ছে, রাষ্ট্র ঈশ্বরের সৃষ্টি এবং তাঁর ইচ্ছাতেই রাষ্ট্র পরিচালিত। পার্থিব জগতে রাজা ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে শাসনকার্য পরিচালনা করবেন। রাজা তার সকল কাজের জন্য ঈশ্বরের নিকট দায়ী থাকবেন: জনগণের কাছে নয়। আধুনিককালে এ মতবাদ সমর্থনযোগ্য নয়। রাষ্ট্র কোন দৈব প্রতিষ্ঠান নয়: রাষ্ট্র মানুষের সৃষ্ট রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ।
পূর্ববর্তী পরবর্তী
No Comment
মন্তব্য করুন
comment url