প্লেটোর ন্যায়বিচার তত্ত্ব সমালোচনা সহ আলোচনা কর। Plato's Theory of Justice and Criticism
প্লেটোর সময় দর্শন তাঁর ন্যায়বিচার তত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত। ন্যায়বিচার তত্ত্ব তাঁর 'দি রিপাবলিক' পুস্তকের মূল আলোচ্য বিষয়। এমনকি 'দি রিপাবলিক' গ্রন্থের বিকল্প শিরোনাম হলো 'ন্যায়বিচার বিষয়ক গ্রন্থ' (Concerning Justice)। অধ্যাপক স্যাবাইন বলেন, "দি রিপাবলিকের ন্যায়বিচার তত্ত্বের মধ্য দিয়ে প্লেটোর রাষ্ট্রীয় মতবাদ চূড়ান্ত বা সর্বোচ্চ শিখরে দাঁড়িয়েছে।"
প্লেটোর কাছে ন্যায়বিচার এর সাধারণ অর্থের মত তথা 'ঔচিত্য' বা 'অন ঔচিত্যবোধক' নয়, বরং তা যোগ্যতা ও শ্রমবিভক্তির ধারণার উপর সুপ্রতিষ্ঠিত। প্লেটোর সময় ক্রমঃক্ষয়িষ্ণু এথেন্সের নগররাষ্ট্রে যে সংকট দেখা দিয়েছিল, তিনি সে সংকটকে সাধারণভাবে 'ন্যায়ের সংকট' বলেই মনে করেছিলেন। ন্যায়ের সংকট বলতে তিনি বুঝাতে চেয়েছেন, 'যার যে যোগ্যতা আছে, সে সেখানে না থেকে অন্যত্র অবস্থান করছে। অর্থাৎ যারা শাসন করছেন তারা শাসক হওয়ার উপযুক্ত নন। শাসন একটি শিল্প ও গুণ। এই গুণ যাদের মধ্যে বিরাজমান কেবলমাত্র তারাই হবেন শাসক। তবেই রাষ্ট্রের কাজকর্ম সুষ্ঠু ও ঐক্যের ভিত্তিতে পরিচালিত হবে। মানুষের জীবনে আসবে স্থায়ী শান্তি।
উপরোক্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে প্লেটো মানুষকে তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন। প্লেটোর মতে প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যে তিন ধরনের উপাদান রয়েছে, যেমন (১) প্রজ্ঞা (wisdom), (২) সাহস (courage), ও (৩) প্রবৃত্তি (appetite)। ব্যক্তি জীবনের এই তিন ধরনের অবস্থার সমন্বয় বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে বিভিন্নভাবে ঘটে থাকে। যেমন, কারও মধ্যে প্রজ্ঞার মাত্রা অধিক, আবার কারও মধ্যে প্রবৃত্তির মাত্রা অধিক। আবার কারও মধ্যে সাহসের মাত্রা বেশী। এমতাবস্থায় ব্যক্তির জীবনের তিনটি অবস্থার হেরফের রাষ্ট্রীয় জীবনে তিনটি শ্রেণী তৈরী করে থাকে, যথা (১) প্রজ্ঞা বিশিষ্টরা দার্শনিক শ্রেণীভুক্ত (২) সাহসীরা যোদ্ধা শ্রেণী ও (৩) প্রবৃত্তির দ্বারা পরিচালিতরা কৃষক বা উৎপাদক শ্ৰেণীভূক্ত। ব্যক্তি জীবনে যখন বিক্রম ও প্রবৃত্তি প্রজ্ঞার দ্বারা পরিচালিত হয়, তখন ঐ ব্যক্তির জীবনে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে ধরা হয়।
রাষ্ট্রীয় জীবনের বেলাতেও অনুরূপভাবে দার্শনিক, যোদ্ধা ও উৎপাদক শ্রেণী যখন নিজ নিজ যোগ্যতা, প্রকৃতি ও প্রশিক্ষণ অনুযায়ী কাজকর্ম করবে তখন ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে। সুতরাং প্লেটোর মতে ন্যায়বিচার হলো কর্মবিশেষীকরণের মাধ্যমে কর্মবন্টন করা ও যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ করা এবং এ ভাবে পারস্পরিক সুষ্ঠু সমন্বয় সাধন করা। তাই প্লেটোর ভাবধারা অনুযায়ী বলা যায়, 'ন্যায়বিচার হলো সমন্বয় সাধনকারী ও সম্প্রীতিপূর্ণ একটি বন্ধন যা সমাজের বিভিন্ন ব্যক্তিকে এক সূত্রে আবদ্ধ করে। তিনি মনে করেছিলেন, 'ন্যায়বিচার' ঠিকমত প্রতিষ্ঠিত হলে সমাজে কোন প্রকার সংঘাত ও সংঘর্ষ দেখা দিবে না।
প্রতিষ্ঠিত হবে স্থায়ী ভিত্তিক ঐক্য। সংঘাত দূর করাই ছিল প্লেটোর লক্ষ্য। প্লেটোর ন্যায়বিচার তত্ত্ব বিশ্লেষণ করলে বুঝা যায় যে, তিনি নৈপূন্যের (skill) উপর জোর দিয়েছিলেন। যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ পেলে এবং প্রত্যেকে নিষ্ঠার সাথে উক্ত কাজ সম্পন্ন করলে দক্ষতা অর্জিত হবে এবং সমাজ উন্নতির দিকে এগিয়ে যাবে। কেউ কারও কাজে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পাবে না। প্লেটোর ন্যায়বিচার তত্ত্ব তাঁর আদর্শ রাষ্ট্র থেকে বিছিন্ন নয়। তিনি তাঁর ন্যায়বিচার তত্ত্বকে প্রত্যক্ষ করার জন্য আদর্শ রাষ্ট্রের রূপরেখা অংকন করেছিলেন, যেখানে তাঁর মতে প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিরাই অর্থাৎ দার্শনিক শ্ৰেণী হবেন কেবল মাত্রা শাসক।
প্লেটোর ন্যায়বিচার তত্ত্বের সমালোচনা
প্লেটোর ন্যায়বিচার তত্ত্ব নানা দিক থেকে সমালোচিত হয়েছে। যথা:
• এতে রাষ্ট্রের ক্ষমতা অত্যধিক বৃদ্ধি পেয়ে তা প্রকারান্তরে ব্যক্তির অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলেছে। বলে প্লেটোর ছাত্র এবং প্রায় সমসাময়িক, এরিস্টটল মন্তব্য করেছেন।
• সর্বাত্মকবাদী দর্শন হিসেবে প্লেটোর ন্যায়বিচার তত্ত্বকে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিখ্যাত লেখক কার্ল পপার এ জন্য প্লেটোকে 'সর্বাত্মকবাদী ধারণার জনক' বলে আখ্যায়িত করতে চান। কারণ, প্লেটো তাঁর ন্যায়বিচার তত্ত্বে ব্যক্তি ও সমাজকে রাষ্ট্রের ইচ্ছার মধ্যে বিলীন করতে চেয়েছেন।
• প্লেটো তাঁর ন্যায়বিচার তত্ত্বের মাধ্যমে মূলত একটি মাত্র শ্রেণীর আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন- শ্রেণীটি হলো অভিভাবক শ্রেণী। কারণ, তাঁর ন্যায়বিচার তত্ত্বানুযায়ী অভিভাবক শ্ৰেণী (দার্শনিক)ব্যতীত অন্য কোন শ্রেণীর শাসন করার যোগ্যতা ও অধিকার নাই। এভাবে প্লেটো শ্ৰেণী আধিপত্যকে রক্ষা করতে চেয়েছেন।
• প্লেটোর ন্যায়বিচার তত্ত্ব গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে একটি পাকাপোক্ত ধারণা। তা ছাড়া এটি মানবাধিকার বিরোধীও বটে। তিনি তার দর্শনে অভিভাবক শ্রেণীর জন্য ব্যক্তিগত পরিবার ও সম্পত্তি নিষিদ্ধ করে মৌলিক মানবাধিকারের প্রতি আঘাত হেনেছেন।
• প্লেটোর ন্যায়বিচার তত্ত্বে এক ধরনের জগদ্দল এবং অনড় শ্রেণী বিন্যাসের প্রস্তাব করা হয়েছে। এবং সে সাথে এ তত্ত্বে পরিবর্তন ও উন্নয়নকে অস্বীকার করা হয়েছে। শ্রেণী বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার সুযোগ রহিত করে তিনি রক্ষণশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। বেনজামিন ফেরিংটন প্লেটোকে তাই একজন 'প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তাবিদ হিসেবে চিহ্নিত করতে চান।
• আধুনিক ধারণার সাথে প্লেটোর ন্যায়বিচার তত্ত্ব অসঙ্গতিপূর্ণ। কেননা, আধুনিক কালে শ্রেণী ও গোষ্ঠীর প্রাধান্যকে অস্বীকার করা হয়। তাছাড়া প্রায় সকল ক্ষেত্রেই আধুনিক দৃষ্টিভংগি হলো সমতামূখী। অর্থাৎ জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী, নির্বিশেষে সকলেই সমান। তবে বর্তমানকালে দাঁড়িয়ে এ ধরনের সমালোচনাকে প্লেটোর প্রতি অবিচার বলে অনেকে মনে করেন।