বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বিভিন্ন দিক আলোচনা কর।
ভূমিকা : বাংলাদেশ ভারত দক্ষিণ এশিয়ার দুটি প্রতিবেশী রাষ্ট্র, ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের তিন দিকে ভারতের অবস্থান। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। তবে এটি ছিল ভারতের প্রতিপক্ষ পাকিস্তানের কাছ থেকে রণকৌশলগত স্বার্থ অর্জন। কিন্তু স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের উপর ভারতের আগ্রাসী মনোভাব দুটি দেশের সম্পর্ককে ফাটল ধরিয়েছে। ভারতের অনমনীয় মনোভাবের কারণে দ্বিপাক্ষিক সমস্যাগুলো সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না।
বিবদমান বিষয়সমূহ : নিম্নে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার বিবাদ বিষয়সমূহ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
১. সীমান্ত সমস্যা : ভৌগোলিকভাবে ভারতের সাথে বাংলাদেশের সীমা রেখা রয়েছে। উভয় দেশের সীমারেখার দৈঘ্য ৪,১৫৬ কিলোমিটার, তবে ৮২ কি. মি. সীমানা নিয়ে উভয় দেশের মধ্যে বিরোধ চলছে। ১৯৭৪ সালের ১৫ মে মুজিব ইন্দিরা সীমান্ত চুক্তি হয়। কিন্তু পরবর্তী তা আমলে আসেনি। ২০০১ সালে রেদমারী সীমান্তে বিডিআর ও বিএসএফ এর মধ্যে প্রবল সংঘর্ষ বাঁধে। ফলে উভয় দেশের সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয়। বিএসএফ বাংলাদেশি সীমানায় বাংলাদেশ-এর নিরীহ মানুষদের পাখির মতো গুলি করে হত্যা করছে। যা মানবতা বিরোধী কাজ। চোরাচালান মাদকদ্রব্য পাচার, মানব পাচার প্রভৃতি অপরাধ কর্মের জন্য সীমান্ত সমস্যা পুনরায় জটিল রূপ ধারণ করেছে।
২. পানি বণ্টন সমস্যা : ভারত-বাংলাদেশের বিবাদ বিষয়গুলোর মধ্যে পানি বণ্টন সমস্যা অন্যতম। কেননা উভয় দেশের মধ্যে অভিন্ন নদীর সংখ্যা ৫৪টি। বাংলাদেশের অধিকাংশ নদীর উৎসস্থল হলো ভারত। এজন্য পানি প্রবাহের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের উপর নির্ভরশীল। ১৯৭৪ সালে ভারত ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ শুরু করলে বাংলাদেশের পদ্মা নদীর স্রোতধারা কমে যায়। শুকনো মৌসুমে বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের কৃষিকাজ ব্যাহত হয়। নদীর প্রবাহ কমে গিয়ে অধিকাংশ নদীর তলদেশের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৭২ সালে দুটি দেশের মধ্যে নদী কমিশন গঠিত হলেও কোনো আমলে আসেনি। ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর দুই দেশের মধ্যে ৩০ বছরের জন্য পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু সে অনুযায়ী বাংলাদেশ পানি পাচ্ছে না।
৩. বাণিজ্য ঘাটতি : বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বড় অন্ত রায় হলো বাণিজ্য ঘাটতি। বাংলাদেশ চীনের পর ভারত থেকে বেশি পণ্য আমদানি করে। কিন্তু বাংলাদেশি পণ্য ভারতের বাজারে প্রবেশ পারে না। অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করায় বাংলাদেশ ভারতে পণ্য রপ্তানি করতে পারছে না। ১৯৭৩-৭৪ সালে উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্য সহযোগিতার লক্ষে কিছু চুক্তি | স্বাক্ষরিত হলেও কোনো আমলে আসেনি। ভারতের আগ্রাসী মনোভাবের কারণে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
৪. চোরাচালান : বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত এলাকা থাকায় চোরাচালান ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। সীমান্ত এলাকা দিয়ে প্রচুর পরিমাণ ভারতীয় পণ্য বাংলাদেশে অবৈধভাবে প্রবেশ করছে। সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের এমন কোনো গ্রাম নেই। যেখানে ভারতীয় পণ্য পাওয়া যায় না। অবৈধভাবে ভারত থেকে যেসব পণ্য বাংলাদেশে প্রবেশ করে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: গরু, চিনি, তামাক, মাদক দ্রব্য প্রভৃতি। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৯৪ সালে ৮৩ ভাগ পণ্য অবৈধভাবে ভারত থেকে | বাংলাদেশে প্রবেশ করে। সম্প্রতি এর প্রবণতা আরো বেশি বৃদ্ধি। পেয়েছে। ফলে বাংলাদেশের স্থানীয় শিল্প বিপাকে পড়েছে।
৫. সন্ত্রাসবাদ : ভারতে বিপুল পরিমাণ সন্ত্রাসী সংগঠন রয়েছে। এরূপ সংগঠনের সংখ্যা প্রায় ৪১টি। ভারতের সাথে বাংলাদেশের সীমান্ত সংযোগ থাকায় ভারতে দাগী সন্ত্রাসীগুলো অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। ফলে বাংলাদেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ধর্মীয় উপসনালয়গুলোতে ব্যাপক সন্ত্রাসী হামলা হচ্ছে। যা দেশের শৃঙ্খলাকে বিনষ্ট করছে। তাই সন্ত্রাসবাদ বিষয় নিয়ে দুই দেশের মধ্যে ধন্য দেখা দিয়েছে।
৬. আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প : ভারত তার উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে পানি সরবরাহের জন্য যে পরিকল্পনা গ্রহণ করে তাই হলো আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প। এই অঞ্চলে পানির চাহিদা মেটানোর জন্য ভারত গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র নদীতে বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার করে। তাই সেসব নদীর পানি প্রবাহ বন্ধ হলে বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব বয়ে আনবে। ভারত তার উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে কৃষিকাজের সম্প্রসারণের জন্য এই প্রকল্প হাতে নেয়। ৩০টি আন্তর্জাতিক নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে এই এলাকায় পানি সরবরাহ করা হবে যা হবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় আন্তঃনদী প্রকল্প। বিশেষজ্ঞদের ধারণা এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের নদীর স্বাভাবিক স্রোতধারা কমে গিয়ে পরিবেশের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। তাই বাংলাদেশ এই প্রকল্প বাস্তবায়ন না করার জন্য ভারতের কাছে অনুরোধ করে।
৭. তিস্তা নদীর পানি বণ্টন সমস্যা : বাংলাদেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প হলো তিস্তা সেচ প্রকল্প। এই প্রকল্পের আওতায় রয়েছে নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলায় ১২টি উপজেলার ৬০ হাজার ৫০০ হেক্টর জমি। ২০১৪ সালের পর থেকে এ নদীর পানি প্রবাহ অব্যাহতভাবে কমছে। ফলে শুষ্ক মৌসুমে কৃষিকাজ ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। তিস্তা চুক্তি কার্যকরী না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ সেচ প্রকল্পের জন্য নায়সঙ্গত পরিমাণ পানি ছাড়তে দিল্লিকে অনুরোধ করেছে। বাংলাদেশের ১৪ শতাংশ জমি তিস্তা নদীর পানির উপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশের জন্য তিস্তা নদীর ভূমিকা রয়েছে। তাই আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে তিস্তার পানি সমান ভাগ করে নিতে হবে।
৮. পুশইন ও পুশব্যাক: ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উড়িষ্যা, ত্রিপুরা প্রভৃতি অঞ্চলের বাংলা ভাষাভাষী ভারতীয় নাগরিক বাস করে। কিন্তু ভারত সরকার মনে করে এসব নাগরিক অবৈধভাবে বাংলাদেশ থেকে এসেছে। এজন্য সরকার বাংলাভাষী নাগরিককে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিতে আগ্রহী। এরূপ নাগরিক বাংলাদেশে পাঠানোকে পুশইন বলে। বাংলাদেশ সরকার এসব নাগরিককে বাংলাদেশি নয় বলে ভারতে পাঠিয়ে দিতে একে পশুব্যাক বলে। এরূপ সমস্যাকে কেন্দ্র করে দুটি দেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। যা সীমান্ত হত্যায় রূপ নেয়।
৯. ছিটমহল সমস্যা : বাংলাদেশ-ভারতের বিবদমান বিষয়গুলোর মধ্যে ছিটমহল সমস্যা অন্যতম। স্বাধীনতার পর থেকে এই সমস্যা উভয় দেশের সম্পর্কে টানাপোড়েন সৃষ্টি করে। কিন্তু সম্প্ৰতি ছিটমহল সমস্যার সমাধান হয়েছে।
১০. বাংলাদেশের জলসীমায় তেল গ্যাস অনুসন্ধান : বঙ্গোপসাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধানকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ভারত সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হওয়ায় ভারত ও বাংলাদেশের জলসীমার কাছাকাছি তেল গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা করে। বাংলাদেশ এ বিষয়ে প্রতিবাদ করলেও ভারত তার নৌজাহাজ বাংলাদেশের জলসীমানা থেকে সরিয়ে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। ২০০৮ সালে এরূপ সমস্যাকে কেন্দ্র করে সামরিক উত্তেজনা সৃষ্টি হয় উভয় দেশের মধ্যে।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশ-ভারতের বিবদমান বিষয়গুলো উভয় দেশের সম্পর্কের অবনতির মূল কারণ। ভারতের আগ্রাসী মনোভাব এরূপ সমস্যার জন্য দায়ী। তাই এই সমস্যাগুলোর সমাধান করা অতি প্রয়োজন। এশিয়ার অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে হলে ভারতকে বাংলাদেশের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। ভারতের উদার দৃষ্টিভঙ্গি পারে এরূপ সমস্যার সমাধান করতে।