রাজনৈতিক দলের কার্যাবলি সম্পর্কে আলোচনা কর | Functions of Political Parties

রাজনৈতিক দলের ভূমিকা |রাজনৈতিক দলের কার্যাবলি - Functions of Political Parties


আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলের ভূমিকা অনস্বীকার্য। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাজনৈতিক দলের কার্যাবলি প্রসঙ্গে রাষ্ট্রে ক্ষমতা গ্রহন ছাড়াও অন্য কতকগুলো কার্যক্রমের কথা বলেছেন। এসব কার্যক্রমের মধ্যে আছে রাজনৈতিক নিয়োগ, রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ, স্বার্থের সমষ্টিকরণ ও স্বার্থের গ্রস্থিকরণ। আধুনিক যুগে রাজনৈতিক দলের নীতি আদর্শের মধ্যে পার্থক্য থাকতে পারে কিন্তু সকল দলের কার্যাবলি প্রায় একই রকম।





রাজনৈতিক দলের কার্যাবলি | রাজনৈতিক দলের ভূমিকা - Functions of Political Parties


সাধারণ চিন্তাধারায় রাজনৈতিক দলের কার্যাবলিকে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা, রাষ্ট্র ক্ষমতা লাভ ও পরিচালনা সংক্রান্ত কার্যাবলির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাজনৈতিক দলের কার্যাবলি কেবলমাত্র ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট বলে মনে করেন না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অ্যালান বল ( Alan Ball) এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন, “রাজনৈতিক দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে ঐক্যবদ্ধ, সরলীকৃত এবং স্থিতিশীল করা।" নিচে রাজনৈতিক দলের নানাবিধ কার্যাবলি সম্পর্কে আলোচনা করা হল:

১। রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্থায়িত্ব সংরক্ষণ : রাজনৈতিক পদ্ধতির ঐক্যবদ্ধকরণ ও সংরক্ষণ রাজনৈতিক দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে স্থায়ী করতে যে সকল পদক্ষেপ নেওয়ার দরকার সেগুলো রাজনীতি দল নিয়ে থাকে। রাজনৈতিক দলের কার্যপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্র তথা রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংহতি ও স্থায়িত্ব সংরক্ষিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়।

২। রাষ্ট্র ক্ষমতা লাভ ও সরকার গঠন : প্রতিটি রাজনৈতিক দলের মূল লক্ষ্য হল রাষ্ট্র ক্ষমতা লাভ এবং সরকার গঠন। ক্ষমতায় এসে নিজের কর্মসূচি ও মতাদর্শকে বাস্তবায়িত করার জন্য প্রতিটি দলই উদ্যোগ গ্রহণ করে। আধুনিক গণতান্ত্রিক দেশে একাধিক রাজনৈতিক দল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতা করে। শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত দলের লক্ষ্য হল ক্ষমতায় টিকে থাকা। আর বিরোধী দলসমূহ নিজ-নিজ আদর্শের ভিত্তিতে শাসক দলকে ক্ষমতাচ্যূত করতে চায়।

৩। রাজনৈতিক সংযোগ সাধন : আধুনিক কালের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল রাজনৈতিক সংযোগ সাধন। রাজনৈতিক দল সরকার ও জনসাধারণের মধ্যে সংযোগ সৃষ্টি ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা পালন করে। সরকারের দায়িত্ব ও ভূমিকা এবং নাগরিক অধিকার সম্পর্কে দল জনগণকে অবহিত ও সতর্ক করে। স্ব স্ব মতাদর্শ ও কর্মসূচির পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক দল নির্বাচকমন্ডলীকে শিক্ষিত ও সচেতন করে তোলে। 

৪। রাজনৈতিক নিয়োগ : রাজনৈতিক দল রাজনৈতিক নিয়োগের একটি অন্যতম প্রধান মাধ্যম। রাজনৈতিক নিয়োগ বলতে বোঝায়, কোন ব্যক্তিকে রাজনৈতিক ভূমিকায় অবতীর্ণ করানো। রাজনৈতিক দল প্রতিটি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এ নিয়োগের দায়িত্ব বহন করে।

৫। রাজনৈতিক অংশগ্রহণ: রাজনৈতিক কার্যকলাপে নাগরিকদের অংশগ্রহণের সুযোগ ও সম্ভাবনা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক দল জনসাধারণের সামনে বিভিন্ন রাজনৈতিক সমস্যা তুলে ধরে। এ সমস্ত রাজনৈতিক বিষয়াদি বিশ্লেষণের মাধ্যমে তাদের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। তার ফলে রাজনৈতিক কাজকর্মে জনসাধারণের অংশগ্রহণের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।

৬। সমস্যা নির্বাচন : আধুনিক রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও অসংখ্য সমস্যা বিদ্যমান। অসংখ্য সমস্যাবলির মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলো নির্ধারণ করা রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাথমিক কাজ।

৭। সমস্যা সমাধান: রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাবলির ব্যাপারে রাজনৈতিক দল গুলি নিজ নিজ দলীয় মতাদর্শের উপর ভিত্তি করে সেসব সমস্যার সমাধানকল্পে নীতি ও কর্মসূচি নির্ধারণ করে। প্রতিটি রাজনৈতিক দল বিশ্বাস করে যে, তার অনুসৃত নীতি ও কর্মসূচি অনুসরণ করে সমস্যার সমাধান সম্ভব।

৮। জনমত গঠন : নির্ধারিত নীতি ও কর্মসূচির স্বপক্ষে জনমত গঠন করা রাজনৈতিক দলের উল্লেখযোগ্য কাজ। প্রতিটি দল সভা-সমিতি, পত্র-পত্রিকা, পুস্তক-পুস্তিকা, রেডিও-টিভি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্রভৃতির মাধ্যমে প্রচারকার্য চালিয়ে নিজস্ব নীতি ও কর্মসূচির সমর্থনে জনমত গঠনের চেষ্টা করে। 

৯। প্রার্থী মনোনয়ন: আধুনিক গণতন্ত্রে প্রতিটি স্বীকৃত রাজনৈতিক দলের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হল নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন করা। এই লক্ষ্যে নির্বাচনের সময় তারা প্রার্থী মনোনয়ন করে এবং সেসব প্রার্থীর সমর্থনে নির্বাচনী প্রচার কার্য চালায়। 

১০। প্রতিশ্রুতি রক্ষা: প্রতিটি রাজনৈতিক দলের মূল লক্ষ্য হচ্ছে রাষ্ট্র সরকারি ক্ষমতা করায়ত্ব করে নিজ নীতি ও আদর্শকে বাস্তবে রূপায়িত করা। নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সমর্থন পেলে সেই উদ্দেশ্যকে সফল করে তোলার সুযোগ উপস্থিত হয়। যে দল নির্বাচনের প্রাক্কালে জনগণের নিকট প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি যথাযথভাবে পালন করতে পারে, সেই দল পরবর্তী নির্বাচনের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসমর্থন লাভ করার সম্ভাবনা থাকে।

১১। সমন্বয় সাধন : সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সহযোগিতার বন্ধন সুদৃঢ় না হলে শাসন কার্য সুষ্ঠুভাবে সম্পাদিত হতে পারে না। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সহযোগিতার বন্ধন সুদৃঢ়করণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ক্ষমতা-স্বতন্ত্রীকরণ নীতির উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থায় আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের মধ্যে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলই সহযোগিতার সেতু রচনা করে।

১২। সরকার ও জনগণের মধ্যে সংযোগ সাধন : আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের সাথে জনসাধারণের সংযোগ রক্ষা করে। সরকারি নীতির স্বপক্ষে ও বিপক্ষে প্রচারকার্য চালিয়ে জনমত গঠন করা রাজনৈতিক দলগুলোর কাজ।

১৩। মতৈক্যের ভিত্তি : রাজনৈতিক দল জনসাধারণের মধ্যে মতৈক্যের ভিত্তি প্রস্তুত করে। জনসাধারণের বৃহত্তর আস্থা ছাড়া কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষেই টিকে থাকা সম্ভব নয়। 

১৪। জাতীয় স্বার্থ: রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের মধ্যে জাতীয় স্বার্থের বোধ সৃষ্টিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। রাজনৈতিক দলের নানাবিধ কার্যক্রম দ্বারা জাতি, বর্ণ কিংবা ধর্মগত সংকীর্ণতা দূর হয়ে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে দেশবাসীর মধ্যে স্বদেশ প্রেম জাগত হয়।

পরিশেষে বলা যায় যে, রাজনৈতিক দলের কার্যাবলি বহুমুখী। রাজনৈতিক দলবিহীন আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিচালনা সম্ভব নয়। রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসার মধ্য দিয়ে নিজ-নিজ নীতি ও কর্মসূচী বাস্তবায়ন করতে চায়।


পূর্ববর্তী পরবর্তী
No Comment
মন্তব্য করুন
comment url