রাজনীতিক দল কি? রাজনৈতিক দল কাকে বলে? রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞা দাও || রাজনৈতিক দলের বৈশিষ্ট্যসমূহ কি কি?

রাজনৈতিক দল ব্যবস্থা বর্তমান প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থার একটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য। কার্যত বর্তমান যুগে রাজনৈতিক দলের সাহায্যেই শাসনকার্য পরিচালিত হয়। এই দলীয় রাজনীতির উদ্ভব অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিক কালের ঘটনা। জন লে (John Blondel)-এর মতানুসারে দল-ব্যবস্থার আলোচনা এখনও প্রাথমিক পর্যায়েই থেকে গেছে। প্রাচীনকালে মিসর ও রোমে বিভিন্ন বংশ ও গোষ্ঠী রাজনৈতিক দলের ভূমিকা গ্রহণ করত। 

মধ্যযুগে সেই কর্তৃত্ব অভিজাত সম্প্রদায়, পুরোহিত সম্প্রদায়, বণিক শ্রেণির মত সমসাময়িক প্রভাবশালী সম্প্রদায়ের হাতে চলে যায়। প্রাচীনকালে গ্রিক নগর রাষ্ট্রে বা রোমের নগর জীবনে অথবা মধ্যযুগে রাজনৈতিক দলের উপযোগিতা অনুভূত হয়নি। প্রকৃত প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ও বিকাশের বিষয়টি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিকাশের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। আধুনিক অর্থে রাজনৈতিক দলের সৃষ্টি হয় সপ্তদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে। রাণী প্রথম এলিজাবেথের রাজত্বকালে হুইগ (Whig) ও টোরি (Tory) নামক দুইটি দলের সৃষ্টি হয় ।

রাজনৈতিক দল কাকে বলে | রাজনীতিক দল কি | রাজনৈতিক দল বলতে কি বুঝ| রাজনৈতিক দল সম্পর্কে লিখ |রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞা | Political Party 

বর্তমানে দলব্যবস্থা হল গণতন্ত্রের প্রাণস্বরূপ। রাজনৈতিক দল সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মতভাবে আলোচনা মূলত: শুরু হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে। রাজনৈতিক দল নিয়ে যে শাস্ত্র আলোচনা করে তা "Stasiology" নামে পরিচিত। 'Stasis" শব্দের অর্থ বিরোধীতার মনোভাব। এই শব্দটি গ্রিক থেকে ইংরেজি ভাষায় এসেছে। বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞা দিয়েছেন। এসব সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করে বলা যায়, বেশ কিছু সংখ্যক ব্যক্তি যদি রাষ্ট্রের সামাজিক, রাজনৈতিক প্রভৃতি বিশেষ সমস্যা সংক্রান্ত কতকগুলো মূল বিষয়ে সম-মতাবলম্বী হয় এবং মতাদর্শের মূলগত এঁকোর ভিত্তিতে দেশের উন্নতি বিধানের জন্য শাসন পরিচালনার সুযোগ লাভের উদ্দেশ্যে সংঘবদ্ধভাবে প্রচারকার্য চালিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা লাভের চেষ্টা করে তবে সেই সংঘবদ্ধ ব্যক্তিবর্গের সংগঠনটিকে রাজনেতিক দল বলে।

রাজনৈতিক দল হল গণতন্ত্রের মূল চালিকা শক্তি। যখন কিছু সংখ্যক মানুষ মতাদর্শগতভাবে একমত পোষণ করে এবং ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয় তখন তাকে রাজনৈতিক দল বলে। সংক্ষেপে রাজনৈতিক দল হল একটি জনসমষ্টি যা ক্ষমতা অর্জন করার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে চেষ্টা করে। ব্যাপক অর্থে বলা যায়, রাজনৈতিক দল হল কোন জনসমষ্টি যা রাষ্ট্রের সমস্যাবলি এবং সমাধানের উপায় সম্পর্কে ঐক্যমত পোষণ করে এবং নির্দিষ্ট আদর্শের ভিত্তিতে জনমতের মাধ্যমে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার চেষ্টা করে।

এন্ডমন্ড বার্ক (Edmund Burke) বলেন, "কতকগুলো নির্দিষ্ট নীতির ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থ সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে সম্মিলিত জনসমষ্টিকে রাজনৈতিক দল বলা হয়।

অধ্যাপক আর্নেস্ট বার্কার (Emest Barker) এর মতানুসারে, “বিভিন্ন মতবাদের দ্বারা পরিচালিত হলেও সকল রাজনৈতিক দলই জাতীয় স্বার্থের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে সমগ্র জাতির সাধারণ স্বার্থ সম্পর্কিত বিষয়ে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণের দ্বারা নির্বাচকমন্ডলীর সমর্থন পেতে সচেষ্ট হয়।”

অধ্যাপক আর এম ম্যাকাইন্ডার (R.M. Maclver) বলেন, নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে কোন সংঘবদ্ধ জনসমাজ বৈধ। উপায়ে শাসন ক্ষমতা দখল করতে চেষ্টা করলে তাকে রাজনৈতিক দল বলে।

অতএব, রাজনৈতিক দল বলতে সাধারণভাবে বুঝায় একই রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী এমন এক দল নাগরিককে যারা সংঘবদ্ধ হয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য গঠনের জন্য শাসনতান্ত্রিক উপায়ে সরকারি ক্ষমতা লাভের চেষ্টা করেন।

রাজনৈতিক দলের বৈশিষ্ট্যগুলো কি কি | রাজনৈতিক দলের বৈশিষ্ট্যসমূহ | Characteristics of Political Parties 

রাজনৈতিক দলের একটি ছাত্রী সংগঠন থাকে এবং এ সংগঠনের মাধ্যমে এটি কাজ করে। একটি রাজনৈতিক দলের সদস্যবৃন্দ একই মতাদর্শে বিশ্বাসী হয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা অর্জনের জন্য কাজ করে। নিম্নে রাজনৈতিক দলের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ তুলে ধরা হল

১। সমমতাদর্শ : একই মতাদর্শে অনুপ্রাণিত, ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত নাগরিকদের নিয়ে রাজনৈতিক দল গঠিত হয়। ব্যাপক কার্যক্রম প্রসঙ্গে কিংবা কর্ম পদ্ধতি দলের সদস্যদের মধ্যে মতবিরোধ থাকতে পারে। কিন্তু একটি দল হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য এর সদস্যদের মধ্যে মতাদর্শের মূলগত ঐক্য থাকতে হবে ।

২। নির্দিষ্ট কর্মসূচি: প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের নির্দিষ্ট কর্মসূচি থাকে। এই কর্মসূচিকে বাস্তবে রূপায়িত করার জন্য দলগুলো নিয়মতান্ত্রিক এবং সংবিধানসম্মত পদ্ধতিতে অগ্রসর হয়।

৩। জাতীয় স্বার্থ: রাজনৈতিক দল মাত্রই জাতীয় স্বার্থের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়। প্রত্যেক দল সমগ্র জাতির সাধারণ স্বার্থ সাধনে আত্মনিয়োগ করে। অন্যথায় তা জনবিচ্ছিন্ন দলে পরিণত হয়।

৪। আলাপ-আলোচনা: দেশ ও দেশবাসীর সমসাময়িক সমস্যাদি সম্পর্কে অবিরত আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে দলমাত্রই নিজ মতাদর্শের অনুকূল জনমত গঠনের চেষ্টা করে।

৫। সরকার গঠন: সকল রাজনৈতিক দলের প্রধান লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হল জনগণের মতামতের ভিত্তিতে নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করা এবং শাসনকার্য পরিচালনার মাধ্যমে দলীয় আদর্শ ও উদ্দেশ্যকে কার্যকর করা। এ কারণে রাষ্ট্র ক্ষমতা লাভের উদ্দেশ্যহীন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, কল্যাণমূলক বা অন্য কোন ধরণের সংগঠনকে রাজনৈতিক দল বলা হয় না। জোসেফ শামপিটার (Joseph Schumpeter) বলেন, "The first and foremost aim of each political party is to prevail over others in order to get into power or to stay in it."

৬। রাজনৈতিক একক: রাজনৈতিক দলের সকল সদস্যের মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতা থাকা আবশ্যক। দলের সদস্যদের কার্যপদ্ধতিতে এমনভাবে সংগঠিত হতে হয়, যাতে করে তারা একটি রাজনৈতিক এককে পরিণত হয়। রাজনৈতিক এককে পরিণত হবার পর তারা দলীয় স্বার্থে কাজ করে থাকে। 

৭। সংঘবদ্ধতা: রাজনৈতিক দলের কর্মীদের একই মনোভাব ও মতাদর্শে সুসংবদ্ধ হতে হয়। তাদের মাঝে রাজনৈতিক ঐক্য ও কর্মস্পৃহা থাকতে হয়।

৮। নিয়মতান্ত্রিকতা: রাজনৈতিক দলের মূল লক্ষ্য ক্ষমতা গ্রহণ হলেও, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতে সে পথ হবে নিয়মতান্ত্রিক। নিয়মতান্ত্রিক বা শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতিই ক্ষমতা অর্জনের মূলমন্ত্র। একটি গণতান্ত্রিক দল কখনোই রাজনৈতিক দল নীতি-বহির্ভূত পদ্ধতিতে ক্ষমতায় আসতে পারে না। অবৈধ ক্ষমতা দখল বৈধতার সংকট তৈরি করে।

৯। দল গঠন: কেবলমাত্র নিজ দেশের নাগরিকগণই রাজনৈতিক দল গঠন করতে পারেন; বিদেশি নাগরিকগণ পারেন না। মতাদর্শ, জাতি, ধর্ম, অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং কর্মপন্থার বিভিন্নতা দারুন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সৃষ্টি হয়ে থাকে।

১০। দলীয় আদর্শ অনুশীলন : গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতে একটি রাজনৈতিক দল নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যায়। ক্ষমতায় যাওয়ার পথে যে কোন দলকে তার মতাদর্শ বিষয়ে জনগণকে জানাতে হয়। জনসমর্থন পেয়ে ক্ষমতায় যেতে পারলে, একটি রাজনৈতিক দল তাদের মতাদর্শ বাস্তবায়নের বৈধতা পায়।

পরিশেষে বলা যায়, রাজনৈতিক দল হচ্ছে মতাদর্শ ভিত্তিক সুসংবদ্ধ সংগঠন। এই সংগঠনের মূল লক্ষ্য বা ক্ষমতা লাভ করা। রাজনৈতিক দলকে জনসমর্থন আদায়ের জন্য রাজনৈতিক কর্মসূচির বাইরেও, আর্থ-সামাজিক বিষয়াদি নিজ কর্মসূচিতে সন্নিবেশিত করতে হয়।
পূর্ববর্তী পরবর্তী
No Comment
মন্তব্য করুন
comment url