আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার বলতে কি বোঝা? আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের পক্ষে যুক্তিগুলো কি

আত্মনিয়ন্ত্রণ কি | আত্মনিয়ন্ত্রণ বলতে কি বুঝায় | আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার | আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার কাকে বলে |




আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার কি? মানব ইতিহাসে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার নীতি এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। জাতীয়তাবোধের ভাবধারায় অনুপ্রাণিত জনসাধারণের প্রাণের আকুতি হচ্ছে অত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার। এই অধিকার কায়েম করে একটি জনগোষ্ঠী তাদের শাসন অবস্থা সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হলে তা জাতীয় রাষ্ট্রে রূপলাভ করে। আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার নীতির প্রবক্তা জন স্টুয়ার্ট মিল তাঁর Representative Government গ্রন্থে বলেন, “যেখানেই জাতীয়তার ভাব বেশ প্রবল আকার ধারণ করেছে, সেখানেই এক জন সম্প্রদায়ের সকল লোককে এক শাসনে ঐক্যবদ্ধ করা এবং তাদের জন্য এক স্বতন্ত্র সরকারের ব্যবস্থা করার যুক্তি রয়েছে।" তাঁর মতে, প্রত্যেক জাতিরই নিজ নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী সরকার গঠন করে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠির অধিকার রয়েছে। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, মানব জাতির একটি সুষ্ঠু অংশ অর্থাৎ একটি জাতি কোন ধরনের শাসন ব্যবস্থা বেছে নেবে তা নির্ধারণ করার অধিকার থেকে সে জাতি যদি বঞ্চিত হয় তাহলে তার স্বাধীনতার কোন অর্থই থাকতে পারে না। জাতির এই আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার নীতি দুটি দিক দিয়ে বিচার করা যেতে পারে।

এক: আইনগত ভাবে জাতীয় জনসমাজের আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবী। 
দুই: আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের পশ্চাতে থাকে ঐতিহাসিক মূল্যবোধ।

যারা আইনগত যুক্তির অবতারণা করেন তারা অস্টিনের সার্বভৌম তত্ত্বের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। তাদের মতে, কোন সুনির্দিষ্ট ভূখন্ডে যদি জনসাধারণ জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে ঐক্যবদ্ধ হয় তাহলে তাদের স্বাধীন জাতি রূপে বেঁচে থাকার দাবী ন্যায়সঙ্গত। প্রকৃত পক্ষে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার বাস্তবে রূপ লাভ করে।

বিগত কয়েক শতাব্দীর রাষ্ট্র ব্যবস্থার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবীকে জোরদার করেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তির পর ১৯১৯ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন ভার্সাই সন্ধি সভায় ঐতিহাসিক ঘোষণায় বলেন যে, জাতীয় ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ প্রতিটি জনসমাজের স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অধিকার রয়েছে। এই সভায় আত্মনিয়ন্ত্রণের নীতি গৃহীত হয়। গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদকে কেন্দ্র করেই ভার্সাই সন্ধির মূল দলিল রচিত হয়। উইলসনের এই ঐতিহাসিক ঘোষণার ফলে ইউরোপে একাধিক জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে। ফিনল্যান্ড, পোল্যান্ড, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুনিয়া, চেকোশ্লোভাকিয় প্রভৃতি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। এশিয়া আফ্রিকার বহু দেশ স্বাধীনতা লাভ করে আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের সার্থকতা প্রতিপন্ন করে।

উড্রো উইলসন বলেন, “ আত্মনির্ধারণের নীতি কেবলমাত্র বাক্যাংশ না এটা কর্মের একটি অপরিহার্য নীতি, এখন থেকে রাষ্ট্রনায়কদের হয় এই নীতি মেনে চলতে হবে আর নাহয় ধ্বংসের মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়াতে হবে।" (Self determination is not a mere phrase, it is an imperative principle of action which statesmen will henceforth ignore at their peril)। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার বলেন যে, প্রতিটি জাতিই যদি স্বাধীনভাবে তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যগুলোর বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হয় তাহলে প্রত্যেক জাতির জ্ঞান-বিজ্ঞানের অবদানে মানব সভ্যতা সমৃদ্ধতর হবে। একটি জাতি অপর জাতির অবদানে লাভবন হয়। পারস্পরিক নির্ভরশীলতাও সহযোগিতার ফলে জাতিগুলোর মধ্যে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি বৃদ্ধি পায় এবং আন্তর্জাতিক সংস্কৃতির উনোষ ঘটে। ফলে যুদ্ধ ও বিরোধের পরিবর্তে শান্তির সুবাতাস প্রবাহিত হয়।

আত্মনিয়ন্ত্রণের নীতি সম্পর্কে লর্ড কার্জনের বক্তব্য খুবই প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন যে, এটা এমন একটা অস্ত্র যার দুদিকে ধার। এটা একদিকে যেমন জনসমাজকে ঐক্যবদ্ধ হবার প্রেরণা যোগায় অন্যদিকে বিচ্ছিন্ন হতেও উদ্বুদ্ধ করে।


আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের পক্ষে যুক্তি






আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার নীতি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করে। এই নীতি বাস্তবায়ন করে মানব সভ্যতা সমৃদ্ধতর হতে পারে। সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা উদ্দেশ্য সাধনে সফল হবে।

• এই নীতির প্রয়োগে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো অধিকতর কার্যকর হয়ে উঠে। ফলে শাসন ব্যবস্থা জনকল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হয়। 

• এই নীতি নৈতিকতার দিক থেকেও উত্তম এবং সমর্থন যোগ্য। জনগণের সম্মতিই হচ্ছে শাসন ব্যবস্থার মূল ভিত্তি।আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার নীতির ক্ষেত্রেও সম্মতি অত্যাবশ্যক এবং অপরিহার্য। 

• আত্মনির্ধারণের নীতির বাস্তবায়নে বিভিন্ন জাতির স্বকীয়তা ও বৈশিষ্ট্য রক্ষা পায় এবং জাতীয় সংস্কৃতির বিকাশ ঘটতে পারে। ফলে সহযোগিতা ও সহমর্মিতার বন্ধন দৃঢ় হয়।

এক জাতি যদি অন্য জাতিকে জোর করে পরাধীন রাখে এবং আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারকে পদদলিত করে তাহলে সমাজে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পরিবেশ সৃষ্টি হয় এবং অশান্তিময় পরিস্থিতি বিরাজ করে। যেমন পাকিস্তানী শাসকচক্র বাঙালিদেরকে জোরপূর্বক শাসন করতে চেয়েছিল। তাদের আত্মনির্ধারণের অধিকারকে অস্বীকার করার ফলে বাংলাদেশের মানুষ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। ইতিহাসের এমন অনেক নজীর আমাদের সামনে রয়েছে। ইংরেজরা ভারতবর্ষের আত্মনির্ধারণের দাবির প্রতি নতি স্বীকার করে এদেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। আলজেরিয়ার আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি উপেক্ষা করার ফলে ফ্রান্সকে সে দেশ থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। ইংল্যান্ড আমেরিকার স্বাধীকারের দাবি অগ্রাহ্য করে জনতার রুদ্ররোষে পড়ে সেখান থেকে চলে আসতে বাধ্য হয়েছে। শাসিতের সম্মতি ব্যতীত কোন শাসন ব্যবস্থা স্থায়ী হতে পারে না। আত্মনির্ধারণের অধিকার মানুষের জন্মগত মৌলিক অধিকার।

সারকথা

শাসিতের সম্মতি ব্যতীত কোন শাসনব্যবস্থা স্থায়ী হতে পারে না। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা। যা বিবেক ও নৈতিকতার দ্বারা সমর্থনযোগ্য না যেখানে বল প্রয়োগ করলে প্রতিকুলতার সম্মুখীন হতে হয়। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার মানুষের জন্মগত অধিকারের উপর প্রতিষ্ঠিত
পূর্ববর্তী পরবর্তী
No Comment
মন্তব্য করুন
comment url