আইন কাকে বলে? আইনের সংজ্ঞা ও আইনের উৎস গুলো কি কি? বিস্তারিত আলোচনা।

আইনের সংজ্ঞা | আইন কাকে বলে | আইন কি| আইন বলতে কি বুঝায়|




আইন কাকে বলে? আইন হলো মানুষের বাহ্যিক আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক প্রবর্তিত নিয়ম-কানুন ও বিধি-বিধান । সমাজের সদস্য হিসেবে মানুষ যে সব বিধি-বিধান মেনে চলে সেগুলোকে সামাজিক আইন বলা যায়। প্রাকৃতিক জগতের ঘটনাবলি যে আইনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয় তাকে বলা চলে প্রাকৃতিক আইন। আবার সমাজবদ্ধ মানুষের আচার-আচরণের প্রকৃতি, ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র সবই আইনের নির্দেশ অনুসারে পরিচালিত হচ্ছে। আইন সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনকে সুপথে পরিচালিত করে।

আর্জেন্টিনা Vs Brazil আজকের খেলা লাইভ | আর্জেন্টিনা বনাম ব্রাজিল লাইভ ম্যাচ 2023 Download: App

আইন কি?  আইনের এই সাধারণ অর্থ ছাড়া রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আইনকে এক বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে প্রত্যক্ষ করা হয়। কোন সংগঠিত সমাজে মানুষের আচার-আচরণ ও পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণের জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক সৃষ্ট ও স্বীকৃত বিধি-বিধানকেই আইন বলে অভিহিত করা হয়। একে রাষ্ট্রীয় আইনও বলা যেতে পারে। রাষ্ট্রীয় আইন ও অন্যান্য আইনের মধ্যে পার্থক্য এখানেই, রাষ্ট্রীয় আইন মান্য করা না হলে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ বল প্রয়োগের মাধ্যমে তা মান্য করতে জনগণকে বাধ্য করতে পারে। আইন লঙ্ঘনকারীকে শান্তি দিতে পারে। কিন্তু অন্যান্য আইনের ক্ষেত্রে কোনরূপ বলপ্রয়োগ করা যায় না।


বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, দার্শনিক, লেখক আইনের সংজ্ঞাকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। এ সব সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করে, আইন কাকে বলে? এ সম্পর্কে যথাযথ ধারণা লাভ করা যায়। চলুন তাহলে জেনে নেই আইন কি? এর কতিপয় প্রামাণ্য সংজ্ঞা_


আইনের প্রামান্য সংজ্ঞা

আইনবিদ জন অস্টিন (John Austin) -এর মতে, "আইন হচ্ছে অধঃস্তন রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের প্রতি ঊর্ধ্বতন রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের প্রদত্ত আদেশ বিশেষ" "Law is the command of the political superior [ Sovereign) to the political inferior") আরো সহজভাবে বলতে গেলে এর অর্থ দাঁড়ায় এরকম 'আইন হচ্ছে সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের আদেশ। 


অস্টিনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে অধ্যাপক হল্যান্ড ( Ho land) বলেন, “কোন সার্বভৌম রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বলবৎকৃত এবং মানুষের বাহ্যিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণকারী সাধারণ বিধিই আইন" (A law is a general rule of external action enforced by the sovereign political authority.)


অধ্যাপক সালমন্ড (Salmond) লিখেছেন, "ন্যায় সংরক্ষণের জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও প্রয়োগকৃত বিধি-বিধানই হলো আইন।"


অপরদিকে স্যার হেনরী মেইন (Sir Henry Maine) আইনের সংজ্ঞা নির্দেশ করেছেন এক ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। তিনি ইতিহাসপন্থী হিসেবে খ্যাত এবং সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বলেন, সকল প্রচলিত আইনকেই সার্বভৌম শক্তির আদেশ বলে অভিহিত করা যুক্তিযুক্ত নয়, কেননা, এমন অনেক আইন আছে যেগুলো সম্পূর্ণরূপে প্রথাগত এবং যে গুলো কখনো সার্বভৌম শক্তি কর্তৃক প্রণীত হয়নি। তাঁর মতে, জনগণের সম্মতি ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব উভয়ে মিলে আইনের সৃষ্টি করে। অবশ্য সমালোচকগণ বলেন, প্রাগুলো আইনে পরিণত হওয়ার জন্য রাষ্ট্রের স্বীকৃতি প্রয়োজন।


রাষ্ট্রবিজ্ঞানী গেটেল (Gettell) আইনের সংজ্ঞা দিতে দিয়ে বলেছেন, "রাষ্ট্র যে সকল নিয়ম-কানুন তৈরি করে, স্বীকার করে এবং বলবৎ করে সেগুলোই কেবল আইন বলে বিবেচিত  হয়।" (Only those rules which the state creates and which it recognizes and enforces become laws.)


আমেরিকার প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন (Woodrow Wilson) আইনকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে: "আইন হলো মানুষের স্থায়ী আচার-ব্যবহার ও চিন্তার সে অংশ যা রাষ্ট্র কর্তৃক গৃহীত বিধি-বিধানে পরিণত হয়েছে এবং যার পেছনে রয়েছে রাষ্ট্রীয় কর্তৃাতের সুস্পষ্ট সমর্থন" "Law is that portion of the established thought and habit which has found a distinct and formal recognition in the shape of uniform rules backed by the authorily and power of the government. "


 রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বার্কার (Barker) অবশ্য লিখেছেন, “আইনকে আদর্শ স্থানীয় হতে হলে তা কেবল রাষ্ট্রীয় সংগঠন কর্তৃক স্বীকৃত, ঘোষিত এবং প্রযোজ্য হলেই চলবে না: তাকে ন্যায়সঙ্গত এবং যুক্তিসঙ্গতও হতে হবে।" অর্থাৎ তাঁর মতে, আদর্শ আইন দু'টো উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত হওয়া বাঞ্ছনীয়- একটি হলো বৈধতা এবং অপরটি হচ্ছে নৈতিক মূল্য। বৈধতা বলতে বোঝায়, আইনটি রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত ও ঘোষিত হয়েছে। আর নৈতিক মূল্য হচ্ছে আইনটি ন্যায়বোধের উপর প্রতিষ্ঠিত। প্রকৃতপক্ষে আইনের নৈতিক মূল্য য-ই হোক না কেন, রাষ্ট্র কর্তৃক যদি তা বৈধ ও ন্যায়সঙ্গত বলে স্বীকৃত হয় তবেই তা সকলের পক্ষে বাধ্যতামূলক বলে পরিগণিত হবে।


উপরোক্ত সংজ্ঞাগুলোর বিশ্লেষণ থেকে আইনের কতিপয় বিশেষ বৈশিষ্ট্য প্রতিভাত হয়ে উঠে। সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের সর্বক্ষেত্রেই আইন প্রযোজ্য। শুধু তাই নয় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও আইন সমভাবে প্রযোজ্য। আইন মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। আইনের অপর একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, এটি অনুমোদিত ও স্বীকৃত। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে আইন অর্থবহ হয়ে উঠে। এছাড়াও আইন জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে সমভাবে সকলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সর্বোপরি, আইন অবশ্য পালনীয়। সকল নাগরিককেই আইন মেনে চলতে হয়। আইনের অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এবং ফলে সভ্য ও শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।


আইনের উৎস | আইনের উৎসগুলো কি কি | আইনের উৎস সমূহ | 




রাষ্ট্র যদিও সকল আইনের উৎস তবুও রাষ্ট্র ছাড়া আইনের আরো অনেক উৎস রয়েছে। নিম্নে আইনের উৎস সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:


• প্রথা ও রীতিনীতি: 

আইনের সর্বপেক্ষা প্রাচীনতম উৎস হচ্ছে প্রথা ও রীতিনীতি। প্রাচীনকালে বিভিন্ন ধরনের প্রধার মাধ্যমেই দ্বন্দ্ব-বিরোধের মীমাংসা করা হত। আধুনিককালেও প্রচলিত প্রথাগুলো আইনের ভাঙা-গড়ার কাজে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রাপ্ত হয়ে আইন জীবন্ত হয়ে ওঠে। ইংল্যান্ডের শাসন ব্যবস্থায় প্রথাগত বিধান এক বিশেষ স্থান দখল করে রয়েছে। সেখানকার সাধারণ আইন (Common Law) মূলত প্রথা থেকে উৎসারিত।


• ধর্ম: 

প্রাচীন সমাজে ধর্ম ও আইন অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত ছিল। তখন আইন ও ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে প্রভেদ করা ছিল দুরূহ। ধর্ম প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আইনের বিবর্তন প্রক্রিয়ায় সাহায্য করেছিল। অধিকাংশ সমাজেই ধর্ম আইনের ভিত্তি হিসেবে ক্রিয়াশীল ছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, সূচনাতে রোমান আইন কতকগুলো ধর্মীয় সূত্র ছাড়া আর কিছুই ছিল না। আধুনিক হিন্দু এবং মুসলিম আইন ধর্ম নিসৃত।


• ন্যায়বোধ:

 ন্যায়বোধ বা ন্যায় বিচার আইনের অপর একটি বিশেষ উৎস। যখন বিচারকগণ প্রত্যক্ষ করেন যে, দেশে প্রচলিত আইনের আওতায় বিচার কার্য সম্পন্ন করা সম্ভবপর নয় তখন তাঁরা তাঁদের ন্যায়বোধ অনুসারে বিচার কার্য সম্পন্ন করে থাকেন। এভাবে নতুন আইনের সৃষ্টি হয়। স্যার হেনরী মেইন (Sir Henry Maine) তাই লিখেছেন, “আইনকে সমাজের ন্যয়বোধের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত রাখতে হলে আনুষ্ঠানিক পদ্ধতি ছাড়া অন্য কোন পদ্ধতিতে সর্বদা আইনের সংশোধনের ব্যবস্থা রাখা আবশ্যক; আর এটিই নায়নোথ।” ন্যায়রোধের মাধ্যমে বিচারকগণ বিচার করে থাবেন বলে একে বলা হয় 'বিচারক প্রণীত আইন' (Judge made law)।


• বিজ্ঞান সম্মত আলোচনা: 

প্রখ্যাত আইন বিশেষজ্ঞদের বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা এবং পর্যালোচনা থেকে আইন লাভ করা যায়। তাঁদের বিভিন্ন বিজ্ঞানভিত্তিক আলাপ-আলোচনা অনেক সময় আইনের প্রকৃত অর্থ প্রকাশ করে। প্রখ্যাত আইনবিদগণ প্রাচীন ও বর্তমান তথ্যাদির তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে আইনের ব্যাখ্যা ও প্রকৃত স্বরূপ তুলে ধরতে সচেষ্ট হন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, যুক্তরাজ্যের আইন ব্যবস্থায় ব্যাকস্টোন (Blackstone) কোক (Coke) প্রমুখ আইনবিদগনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ যুক্তরাজ্যো আইন হিসেবে এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে।


• বিচারের রায়: 

আদিকালে প্রথা ও ধর্মীয় নীতির সাহায্যে সব ধরনের বিরোধ ও দ্বন্দ্বের সমাধান করা হতো। কিন্তু সমাজ জীবনে জটিলতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষ আইনের আশ্রয় গ্রহণ করে। কিন্তু দেখা গেল আইনের মাধ্যমেও মানুষ তাদের সকল সমস্যার সমাধান খুঁজে পেল না। ফলে তারা বিচারকের মতামত ও রায়ের উপর নির্ভর করতে থাকে। ক্রমে বিচারকের রায় আইনে পরিণত হল।


• নির্বাহী ঘোষণা ও ডিক্রী: 

আধুনিক কালে শাসন ব্যবস্থার জটিলতার কারণে আইন সভা নিজের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের কিছু কিছু অংশ নির্বাহী বিভাগের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। ফলে নির্বাহী বিভাগকে বিচ্ছিন্ন সময় বিভিন্ন প্রকার ঘোষণা দিতে হয় এবং ডিক্রী জারি করতে হয়। এভাবে জারিকৃত ঘোষণা ও ডিক্রী আইনের মর্যাদা লাভ করে। নির্বাহী ঘোষণা ও ডিক্রী সাধারণত ordinance হিসেবে ঘোষিত হয় এবং পরবর্তীতে নিয়মতান্ত্রিকভাবে আইনের রূপ লাভ করে।


• আইন সভা: 

আধুনিককালে আইন সভা আইন প্রণয়নের একটি প্রধান উৎস। অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জনমতকেই আইনের একমাত্র উৎস বলে বর্ণনা করেছেন। আর আইনসভার সদস্যরা সর্বদাই জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকেই আইন পণ্যান করেন। আইনসভাই প্রকৃতপক্ষে জনমত, পথা, ন্যায়-নীতি প্রভৃতিকে আনুষ্ঠানিকভাবে আইনের মর্যাদা দান করে। এমনকি আধুনিক কালের আইন সভা সংবিধান প্রণয়ন ও সংশোধনের দায়িত্ব পালন করে।


• সংবিধান:

আইন সভা ছাড়াও আইনের অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হলো সংবিধান। সংবিধানেই রাষ্ট্র পরিচালনার যাবতীয় নিয়ম-কানুন, বিধি-বিধান লিখিত আকারে বিদ্যমান থাকে। আর এই লিখিত সংবিধানই আইনের জনাদাতা।


আইনের তাৎপর্য: 


আইনের তাৎপর্য আলোচনা করো বা আইনের তাৎপর্য ব্যাখ্যা কর।

আইনের তাৎপর্য সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো 


আইন মানব জীবনকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে। এ অর্থে আইন সমাজ তথা রাষ্ট্রের সদস্য হিসেবে মানুষের আচার আচরণ নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে। আইনের অনুপস্থিতিতে সমাজ ও রাষ্ট্রদেহে অরাজকতার সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্র পরিচালিত হয় সরকার কর্তৃক আর সরকার আইনের সাহায্যে রাষ্ট্রের ইচ্ছাকে ব্যাখ্যা ও বাস্তবায়ন করতে সচেষ্ট হয়।


আইন সার্বভৌম ক্ষমতার হাতিয়ারস্বরূপ। প্রকৃতপক্ষে সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে যে কোন আলোচনা আইনের আলোচনা ব্যতীত পূর্ণাঙ্গ হতে পারে না। সার্বভৌমত্ব মূলত এক বিমূর্ত ধারণা এবং আইনের মাধ্যমে প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত তা সত্যিকারভাবে অর্থবহ হয় না।

পূর্ববর্তী পরবর্তী
No Comment
মন্তব্য করুন
comment url