রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করুন

রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য | রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য আছে কি | রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে সম্পর্ক কি |রাষ্ট্র এবং সরকারের মধ্যে পার্থক্য কী | রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে মূল পার্থক্যগুলি উল্লেখ করাে | রাষ্ট্র ও সরকারের পার্থক্য ব্যাখ্যা করাে। রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে সম্পর্ক 


রাষ্ট্র একটি রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত সংস্থা। রাষ্ট্র শাসিত হয় একটি বৈধ সরকার দ্বারা। সরকার ব্যতীত রাষ্ট্রের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। রাষ্ট্র ও সরকারকে অনেক সময় একই অর্থে ব্যবহার করা হয়। ইংরেজ দার্শনিক হবস রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন নি। ফ্রান্সের সম্রাট চতুর্দশ লুই বলতেন, “আমিই রাষ্ট্র”। ইংল্যান্ডের স্টুয়ার্ট রাজারা অনুরূপ ধারণা পোষণ করতেন। কিন্তু বাস্তবে রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য বিদ্যমান। নিচে রাষ্ট্র এবং সরকারের মাঝে বিদ্যমান পার্থক্যগুলো উল্লেখ করা হলো:

রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্যসমূহ

• জনসমষ্টি, ভূ-খন্ড সরকার ও সার্বভৌম ক্ষমতা-এই চারটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান নিয়ে রাষ্ট্র গঠিত। সরকার রাষ্ট্রের অন্যতম উপাদান। সরকার একটি প্রতিষ্ঠান যর মাধ্যমে রাষ্ট্রের ইচ্ছা প্রকাশিত ও কার্যকর হয়। অধ্যাপক গার্নার রাষ্ট্র ও সরকারের পার্থক্য সুস্পষ্ট করার জন্য রাষ্ট্রকে জীবদেহের সঙ্গে তুলনা করেছেন। রাষ্ট্র যদি জীবদেহ হয় তবে সরকার রাষ্ট্রের মস্তিষ্ক স্বরূপ।

• রাষ্ট্র সরকার অপেক্ষা ব্যাপক। রাষ্ট্র দেশের সমস্ত জনসাধারণের সমন্বয়ে গঠিত হয়। কিন্তু সরকার মুষ্টিমেয় মানুষের সমন্বয়ে গঠিত একটি সংস্থা।

• রাষ্ট্র একটি বিমূর্ত ও তত্ত্বগত ধারণা। রাষ্ট্রকে অনুধাবন করতে হয়। সরকার একটি বাস্তব প্রতিষ্ঠান। জনসমষ্টির যে ক্ষুদ্র অংশ নিয়ে সরকার গঠিত হয় তাদেরকে জানা ও দেখা যায়। সরকার রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কার্যসম্পাদন করে। সরকারের মাধ্যমে রাষ্ট্রের ইচ্ছা প্রকাশিত ও বাস্তবায়িত হয়। সরকার না থাকলে রাষ্ট্রের কোন কাজই সুষ্ঠুভাবে করা সম্ভব নয়। রাষ্ট্রকে যদি একটি জাহাজ রূপে গণ্য করা হয় তবে সরকার রাষ্ট্ররূপী জাহাজের নাবিক মাত্র। সরকার পরিবর্তনশীল। বৈধ উপায়ে বা বিপ্লবের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হলেও রাষ্ট্রের কোন পরিবর্তন হয় না। রাষ্ট্র একটি চিরন্তন চিরস্থায়ী প্রতিষ্ঠান। যুগে যুগে সরকার আসে সরকার যায়। কিন্তু রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিলোপ হয় না। একথা সত্য যে যুদ্ধ বা প্রাকৃতিক কারণে রাষ্ট্রের পরিবর্তন বা বিলুপ্তি ঘটাতে পারে। তবে ওটা একটা ব্যতিক্রম।

• রাষ্ট্র সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী, কিন্তু সরকারের কোন সার্বভৌম ক্ষমতা নেই। রাষ্ট্র সার্বভৌম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রের এই সার্বভৌম ক্ষমত সরকারে মাধ্যমে প্রয়োগ হয়ে থাকে। রাষ্ট্র সার্বভৌম ক্ষমতার মাধ্যমে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে।

• রাষ্ট্র সকল আইনগত অধিকারের উৎস, সরকার তার রক্ষক মাত্র। রাষ্ট্রের বিরোধিতা করলে নাগরিক জীবন বিপন্ন হয়। রাষ্ট্রের বিরোধিতা করর অর্থ দেশদ্রোহিতা। সরকার নাগরিক অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ বা কোন অন্যায় পদক্ষেপ গ্রহণ করলে জনসাধারণ সরকারের বিরোধিতা করতে পারে। অধিকার হরণের বিরুদ্ধে কোন নাগরিক সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মামলা করা যায় না।

• সকল রাষ্ট্রের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য এক এবং অভিন্ন। কিন্তু সরকার শ্রেণীগত ও আদর্শগত বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে। যেমন রাজতান্ত্রিক, স্বৈরতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক, এককেন্দ্রিক, যুক্তরাষ্ট্রয়, সংসদীয় ও রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ইত্যাদি।

• রাষ্ট্র বলতে একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডকে বুঝায় এবং অনেক ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু সরকার গঠিত হয় শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের সমন্বয়ে। সরকার ছাড়া রাষ্ট্র কল্পনা করা যায় না।

• রাষ্ট্র সংবিধান দ্বারা নাগরিকের অধিকার সৃষ্টি করে। কিন্তু সরকারের দায়িত্ব ওই অধিকার রক্ষা করা। তবে সরকার প্রয়োজন বোধে নাগরিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে পারে।

• রাষ্ট্রের ক্ষমতা অসীম। কিন্তু সরকার রাষ্ট্র প্রদত্ত সীমিত ক্ষমতার মালিক। রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে। অধ্যাপক লাক্ষি যথার্থই বলেছেন, “প্রশাসনিক দৃষ্টিকোন থেকে কার্যত সরকারই রাষ্ট্র।" সরকার শব্দটি মূলত মন্ত্রিমন্ডলীকে বুঝায়। ব্যাপক অর্থে যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভবে রাষ্ট্রীয় কার্য পরিচালনা করে তাঁদের সমন্বয়ে সরকার গঠিত হয়।

সারকথা

সরকার রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সরকারের মাধ্যমে রাষ্ট্রের ইচ্ছা প্রকাশিত হয়। সরকার ব্যতীত রাষ্ট্রের অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না।

পূর্ববর্তী পরবর্তী
No Comment
মন্তব্য করুন
comment url