রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত মার্কসীয় মতবাদ সম্পর্কে আলোচনা করো।
এ পাঠটি পড়ে আপনি – যে সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন:
* রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত মার্কসীয় মতবাদ সম্পর্কে লিখ।* রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত মার্কসীয় মতবাদ ব্যাখ্যা করুন।
রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত মার্কসীয় মতবাদ
কার্ল মার্কস রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে ভিন্নধর্মী মতবাদ উপস্থাপন করেছেন। তাঁর মতে সমাজ ও রাষ্ট্র এক নয়; আর উভয়ের উৎপত্তিও সম্পূর্ণ ভিন্ন। মার্কস মনে করেন যে, সমাজ একটি স্বাভাবিক প্রতিষ্ঠান কিন্তু রাষ্ট্র তা নয়। মানুষের প্রকৃত সত্ত্বা রাজনেতিক নয় বরং সামাজিক মানুষ রাজনৈতিক জীব নয় বরং যে সব সামাজিক শক্তি মানুষকে দ্বন্দ্ব সংঘাতে লিপ্ত করতো তা রাজনৈতিক ক্ষমতার ও রাষ্ট্রের অধীনস্থ হয়। রাষ্ট্র কোন নৈতিক উদ্দেশে সৃষ্টি হয় নি বরং তা পুঁজিপতি শ্রেণী কর্তৃক সমাজের অপরাপর শ্রেণী বিশেষ করে বিত্তহীন শ্রেণীর উপর শ্রেণী শোষণের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে।
কার্ল মার্কস দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, উৎপাদনের শক্তিগুলো অর্থাৎ অর্থনৈতিক সম্পর্ক অন্যান্য সকল সামজিক সম্পর্কের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। এসব শক্তি সমাজের অবকাঠামোতে বিরাজ করে। আর নৈতিকতা, ধর্ম, প্রথা, রীতিনীতি এমনকি রাজনীতি সমাজের উপরিকাঠামো তৈরী করে। রাষ্ট্র হচ্ছে একটি উপরিকাঠামো এবং তা অর্থনৈতিক উপাদানের উপর নির্ভরশীল। মার্কস বলেন, আইনগত সম্পর্ক এবং রাষ্ট্রের গঠন-রীতি মানব জীবনের বস্তুগত উপাদানের উপর নির্ভরশীল। এই বস্তুগত উপাদানের মধ্যেই তিনি রাষ্ট্রের উৎপত্তি খুঁজে পেয়েছেন। তাঁর মতে আদিকালে যখন সমাজে শ্রেণী ছিল না তখন রাষ্ট্রেরও অস্তিত্ব ছিল না। ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভবের সাথে সাথে রাষ্ট্রেরও উৎপত্তি হয়। রাষ্ট্র তাই শ্রেণী শোষণের হাতিয়ার স্বরূপ। রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে সবল শ্রেণী দুর্বল শ্রেণীকে শোষণ করে থাকে। তিনি মনে করতেন শোষণের ফলে শ্রমিক শ্রেণী সংগঠিত হয়ে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রকে বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক বা শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্রে পরিণত করবে। মার্কস আরও মনে করতেন বিকাশের এক পর্যায়ে শ্রেণী শোষণের অবসান ঘটবে আর তখনই রাষ্ট্র অপ্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। এবং এর অস্তিত্ব বিলুপ্ত হবে। মার্কসের এ তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে ১৯১৭ সালে রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হনে সোভিয়েত ইউনিয়ন নামে রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। একদলীয় এ রাষ্ট্রটি বিংশ শতাব্দির শেষ দশকে বিপ্লপ্ত হয় তবে এ বিলুপ্তি শ্রেণী ও শোষণহীন সমাজের জন্ম না দিয়ে বরং শ্রেণী সম্বলিত পুঁজিবাদী রাশিয়ার জন্ম দিয়েছে। মাওসেতুঙ-এর নেতৃত্বে চীনেও প্রায় অনুরূপ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং পরিবর্তন স্বাপেক্ষে এখনও টিকে আছে। তাছাড়া সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতায় দক্ষিণ আমেরিকাসহ পূর্ব ইউরোপেও তদ্রুপ রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছিল। বলাবাহুল্য, বর্তমানে ঐ সব রাষ্ট্র আবার পুঁজিবাদী পথে ফিরে এসেছে এবং আসছে।
উপসংহার:
এ পাঠে রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে মার্কসীয় মতবাদ ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এ মতবাদের সার কথা এই যে, রাষ্ট্র কোন নৈতিক প্রতিষ্ঠান নয়; রাষ্ট্র কেবলমাত্র এক ধরনের শোষণের হাতিয়ার। রাষ্ট্র মূলত পুঁজিপতি শ্ৰেণী কর্তৃক বিত্তহীন শ্রেণীর উপর শোষণের যন্ত্র হিসেবে কাজ করে। শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হলে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব থাকবে না।