রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে সামাজিক চুক্তি মতবাদটি সমালোচনাসহ আলোচনা কর।

এ পাঠটি পড়ে আপনি – যে সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন:

* সামাজিক চুক্তি মতবাদ কাকে বলে?
* সামাজিক চুক্তি মতবাদের কি?
* সামাজিক চুক্তি মতবাদ সম্পর্কে লেখ।
* হবসের সামাজিক চুক্তি মতবাদ সম্পর্কে আলোচনা কর
* জন লকের সামাজিক চুক্তি মতবাদ সম্পর্কে আলোচনা কর। 
* রুশোর সামাজিক চুক্তি মতবাদ সম্পর্কে আলোচনা কর।
* রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে সামাজিক চুক্তি মতবাদটি সমালোচনাসহ আলোচনা করো।
* রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে হবস, লক ও রুশোর মতবাদ  সমালোচনাসহ আলোচনা কর।
* হবস, লক ও রুশোর মতে সার্বভৌম ক্ষমতার স্বরূপ বিশ্লেষণ করুন।


রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে সামাজিক চুক্তি মতবাদ

রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত মতবাদগুলোর মধ্যে সামাজিক চুক্তি মতবাদ একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে। এই মতবাদ কেবল রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও প্রকৃতিই বিশ্লেষণ করে না এটি রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তার উপরও গুরুত্ব আরোপ করে। রাষ্ট্র বিধাতার সৃষ্টি নয়, কোনরূপ দৈহিক বল বা শক্তির মাধ্যমেও রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয় নি, বরং রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে

সামাজিক চুক্তি মতবাদ কি - Social Contract Theory

রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে সামাজিক চুক্তি মতবাদে বিশ্বাসীদের মতে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পূর্বে কোনরূপ সরকার বা নিয়ন্ত্রণকারী ব্যবস্থার অস্তিত্ব ছিল না। তখন মানুষ 'প্রকৃতির রাজ্যে' (State of Nature) বসবাস করত এবং প্রাকৃতিক বিধি-বিধান মেনে চলত। কিন্তু কালক্রমে কোন প্রকার রাজনৈতিক সংগঠনের অনুপস্থিতিতে উক্ত বিধি-বিধান সুসংহত ভাবে গড়ে উঠতে পারে নি। ফলে সেগুলো পালনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরণের জটিলতা ও অসুবিধা দেখা দেয়। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ লাভ করার জন্য জনগণ সরকার গঠনের লক্ষ্যে চুক্তিবন্ধ হয়ে আইনের অধীনতা স্বীকার করে। কাজেই সামাজিক চুক্তি মতবাদের মূল কথা হল, রাষ্ট্র চুক্তির মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্র সামাজিক চুক্তির ফলস্বরূপ।

রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে সামাজিক চুক্তি মতবাদ বেশ প্রাচীন। গ্রীক দার্শনিক প্লেটো (Plato) এবং এরিষ্টটলের (Aristotle ) রাষ্ট্র দর্শনে সামাজিক চুক্তির কিছুটা আভাস থাকলেও তাঁরা চুক্তিবাদে আস্থা স্থাপন করেন নি। এপিকিউরীয় (Epicurean) দর্শনেও সামাজিক চুক্তির আভাস পাওয়া যায়। মধ্যযুগীয় ইউরোপেও চুক্তিবাদের ধারণ পরিদৃষ্ট হয়। তবে সপ্তদশ শতাব্দীতে টমাস হবস্ (Thomas Hobbies) এবং জন লক (John Locke) এবং অষ্টাদশ শতাব্দীতে জ্যা জ্যাঁক রুশোর (Jean Jaques Rousseau) কাছ থেকে সামাজিক চুক্তি মতবাদ পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা ও সমর্থন লাভ করে। বলা বাহুল্য, এ তিনজন দার্শনিকের প্রত্যেকেই 'প্রকৃতির রাজ্য থেকে শুরু করেন। কিন্তু তাঁরা সকলেই 'প্রকৃতির রাজ্যের স্বরূপ, চুক্তির ধরণ এবং সার্বভৌম কর্তৃত্ব সম্পর্কে ভিন্নমত পোষণ করেন।

হবসের সামাজিক চুক্তি মতবাদের মূলকথা 

হবস ছিলেন সপ্তদশ শতাব্দীর একজন বিখ্যাত ইংরেজ দার্শনিক। সে সময় ইংল্যান্ডের রাজা ও পার্লামেন্টের মধ্যকার ক্ষমতার দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে যে গৃহযুদ্ধের (Civil War) সূচনা হয় তাতে করে আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটে। জনজীবনে চরম বিপর্যয় নেমে আসে। হবস্ এ সময় তখন তাঁর প্রসিদ্ধ “দি লেভিয়াথান" (The Leviathan) গ্রন্থ রচনার মাধ্যমে রাজতন্ত্রকে সমর্থন করেন। উদ্দেশ্য ছিল ইংল্যান্ডের বিদ্যমান গৃহযুদ্ধের অবসান এবং জনজীবনে নেমে আসা বিপর্যয় রোধ করা।

হবস্ রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত ধারণা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সামাজিক চুক্তির আশ্রয় নিয়েছেন। আর সামাজিক চুক্তি বিশ্লেষণে তিনি প্রকৃতির রাজ্য' ('State of Nature") এবং ' মানব প্রকৃতি' ('Human Nature') সম্পর্কে তাঁর অভিমত ব্যক্ত করেছেন। 

হবসের প্রকৃতির রাজ্য কেমন ছিল?

হুসের মতে, রাষ্ট্রের উৎপত্তির পূর্বে মানুষ 'প্রকৃতির রাজ্যে বসবাস করত। এই প্রকৃতির রাজ্যে ছিল। এক ভয়াবহ ও দুঃসহ অবস্থা। সেখানে কোন আইন-শৃঙ্খলা বিদ্যমান ছিলনা। ফলে মানুষ পরস্পর দ্বন্দ্ব-কলহে লিপ্ত থাকত। দুর্বলের উপর ছিল সবলের অত্যাচার ও নিপীড়ন। এমনি পরিবেশে কারো পক্ষে শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন করা সম্ভব ছিল না।

'প্রকৃতির রাজ্যে' 'জোর যার মূলুক তার এই অবস্থা বিরাজমান ছিল। সঙ্গত কারণেই সেখানে কোন ন্যায়বিচারও ছিলনা। মানুষ সর্বদাই ভয়ভীতির মধ্যে জীবন অতিবাহিত করত। হস 'প্রকৃতির রাজ্য' কে বর্ণনা করেছেন এভাবেঃ 'প্রকৃতির রাজ্যে মানব জীবন ছিল নিঃসঙ্গ, দরিদ্র, নির্দয়, পাশবিক এবং ক্ষণস্থায়ী (Life in the State of Nature was solitary. poor, nasty, brutish and short) তিনি আরো বলেন, “ প্রকৃতির রাজ্যে কোন শিল্প, শিক্ষা, ও সমাজের অস্তিত্ব ছিল না, বরং সেখানে ছিল চরম মৃত্যুর নিরন্তর ভয় ও বিপদ"।

হবসের মানব প্রকৃতি কেমন ছিল?

'প্রকৃতির রাজ্যের' উপরোক্ত বর্ণনা দেয়ার পর হবস্ 'মানব প্রকৃতি' সম্পর্কে তাঁর অভিমত ব্যক্ত করেছেন। মানব প্রকৃতিতে তিনি স্বার্থপরতা ও আত্মকেন্দ্রিকতার উপাদান প্রত্যক্ষ করেন। মানুষকে তিনি জড়বস্তুর সঙ্গে তুলনা করে তাদেরকে জড়বস্তুর মতই কার্যকারণ সম্পর্কের নিয়ন্ত্রণাধীন বলে উল্লেখ করেছেন। মূলকথা মানুষ হলো চরম স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক, অবিশ্বাসী এবং কলহপ্রবণ।

'প্রকৃতির রাজা' ও 'মানব প্রকৃতির এরূপ ধারণা থেকে হবস্ এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, মানুষের জন্য একটি উত্তম ও নিরাপদ জীবন যাপনের প্রয়োজন। আর এ কারণে একদিন মানুষ নিজেদের মধ্যে এক চুক্তি সম্পাদন করল। এ চুক্তির মাধ্যমে তারা তাদের সকল অধিকার একজন কর্তৃপক্ষের হাতে সমর্থন করল। হরসের এ চুক্তির প্রকৃতি ছিল এরকম “ আমি নিজেকে শাসন করার অধিকার ত্যাগ করে ঐ ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের হাতে ক্ষমতা সমর্পণ করলাম এ শর্তে যে, তুমিও তোমার অধিকার ঐ একইভাবে তাকে বা তাদের সকলের হাতে অর্পণ করে সকল ক্ষমতা ত্যাগ করবে"।

এভাবে চুক্তির ফলে 'প্রকৃতির রাজ্য' একটি রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়। রাষ্ট্রের শাসনভার অর্পিত হয় একজন সার্বভৌম শাসকের হাতে। এই সাবভৌম শাসকই হলেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। হাঁসের সামাজিক চুক্তিতে জনগণ পরস্পরের সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে জনগণ ও রাজার সঙ্গে কোনরূপ চুক্তি স্থাপিত হয় নি রাজা তথা শাসক ছিলেন চুক্তির বাইরে। ফলে তা একধরনের একতরফা চুক্তিতে (Unitateral Contract) পরিণত হয়। রাজা তাঁর ইচ্ছানুসারে রাষ্ট্রশাসনের ক্ষমতা লাভ করেন, জনগণ রাজার বিরুদ্ধাচরণ করার ক্ষমতা চিরতরে হারায়। এতে করে রাজার পক্ষে স্বেচ্ছাচারী হওয়ার পূর্ণ সুযোগ থেকে গেল। রাজশক্তি সর্বেসর্বা হয়ে উঠে। রাজশক্তির ইচ্ছানুসারে জনগণ যে কোন ধরনের শাস্তি ভোগ করবে। এতে জনগণের অধিকার হয় উপেক্ষিত। হবস মনে করতেন শাসকের উপর জনগণের কর্তৃত্ব করার অধিকার দিলে মানুষ আবার প্রকৃতির রাজ্যে ফরে যেতে পারে। সুতরাং এ অধিকার জনগণের হাতে থাকা সমীচীন নয়।

এভাবে হরস তাঁর সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে ইংল্যান্ডের স্টুয়ার্ট রাজদের স্বেচ্ছাচারী শাসন ও নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রের প্রতি সমর্থন দান করেন। স্বভাবতই তাঁর এ মতবাদ নিরঙ্কুশ, অনিয়ন্ত্রিত ও সর্বাত্নকবাদী রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থার প্রতিবিম্ব।

লকের সামাজিক চুক্তি মতবাদের মূলকথা 

সপ্তদশ শতাব্দীর অপর একজন ইংরেজ দার্শনিক হচ্ছেন জন লক। ১৬৮৮ সালের গৌরবময় বিপ্লবের (Glorious
Revolution) ফলে ইংল্যান্ড যখন গণতন্ত্রের দ্বার প্রান্তে এসে উপস্থিত হয় ঠিক সে সময় তিনি তাঁর বলিষ্ঠ লেখনীর মাধ্যমে গণতন্ত্রকে আরো একধাপ এগিয়ে নিয়ে যান। হসের মত তিনিও সরকারের প্রকৃতি ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সামাজিক চুক্তির উপর নির্ভর করেন। লকের চিন্তায় সামাজিক চুক্তির ধারণা নতুন আঙ্গিকে মূর্ত হয়ে ওঠে। সামাজিক চুক্তির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে লকও হসের মত 'প্রকৃতির রাজ্য' এবং 'মানব প্রকৃতি' সম্পর্কে তাঁর ধারণা প্রদান করেন এবং তারপর সামাজিক চুক্তির প্রকৃতি বিশ্লেষণ করেন। 

লকের প্রকৃতির রাজ্য কেমন ছিল?

লকের মতে, প্রকৃতির রাজ্যে কোনরূপ ভয়াবহ অবস্থা বিদ্যমান ছিল না। সেখানে মানুষের মধ্যে ছিল পূর্ণ শান্তি ও সাম্য। কোনরূপ উচ্ছৃঙ্খলতা, পাশবিকতা, হানাহানি, দ্বন্দ্ব বিরাজমান ছিল না। প্রকৃতির রাজ্যে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে ছিল পরস্পর সহযোগিতা ও সহমর্মিতা। লকের মতে 'প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ প্রাকৃতিক বিধান (Natural Law) এবং 'প্রাকৃতিক ন্যায়নীতির (Natural Justice) অধীনে বাস করত। এ দু'টোর মাধ্যমে জনগণ একে অপরের জীবন, সম্পত্তি ও স্বাধীনতা রক্ষা করত। সুতরাং এটি স্পষ্ট যে, লকের মতে, 'প্রকৃতির রাজ্য ছিল এক নিরবচ্ছিন্ন শান্তি ও স্বর্গীয় আনন্দের প্রতায়।

লকের মানব প্রকৃতি কেমন ছিল?
 
'মানব প্রকৃতি' সম্পর্কেও লকের ধারণা ছিল অতি উচ্চ। তাঁর মতে মানুষ স্বভাবতই যুক্তিবাদী ও শান্তিপ্রিয়। মানব মনে লোভ-লালসা থাকা সত্ত্বেও যুক্তিবোধের মাধ্যমে তারা সে সব প্রবণতা দমিয়ে রাখতে প্রয়াসী হয়। এছাড়াও লক মনে করেন যে, মানুষ নীতিবোধ দ্বারাও পরিচালিত হয়। ফলে সে ভাল মন্দের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে পারে। মানর প্রকৃতি সর্ম্পকে সুউচ্চ ধারণা পোষণ করে তিনি বলেন, সকল মানুষই সমান। মানুষে মানুষে কোন পার্থক্য নেই।

'প্রকৃতির রাজা' ও 'মানব প্রকৃতি সম্পর্কে উত্তম ধারণা পোষণ করা সত্ত্বেও লক বলেন নানা কারণে প্রকৃতির রাজ্যে বিভিন্ন প্রকার বাস্তব অসুবিধা দেখা দিল। জনগণ প্রকৃতিক আইনের ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা দিতে শুরু করল। একজন সর্বজ্ঞাত নিরপেক্ষ আইনের ব্যাখ্যা দাতার অভাবে বিশৃঙ্খলা দেখা দিল। এই বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে পরিত্রাণ লাভের জন্য মানুষ চুক্তির আশ্রয় গ্রহণ করে এবং চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে।

লকের মতে, দুটো চুক্তির মাধ্যমে জনগণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। প্রথম চুক্তিটি সমগ্র জনগণের মধ্যে করা হয়, যার মাধ্যমে সকলে সকলের নিকট তাদের অধিকার সমর্পণ করে। এর ফলে একটি যৌথ সত্তা বা সম্প্রদায়ের হাতে জনগণ তাদের অধিকার প্রদান করল। অপরদিকে দ্বিতীয় চুক্তিটি সংঘটিত হয়, শাসক ও জনগণের মধ্যে। এ চুক্তি অনুসারে শাসক জনগণের নিকট দায়ী থাকবেন এবং তাদের কাছ থেকেই ক্ষমতা লাভ করবেন। শাসক চুক্তি ভঙ্গ করলে জনগণ তাঁকে পদচ্যুত করতে পারবে। ফলে শাসকের পক্ষে স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠা সম্ভব নয়।

এভাবে লক তর সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে ইংল্যান্ডে গৌরবময় বিপ্লবের (১৬৮৮) প্রতি সমর্থন যোগান এবং নিয়ন্ত্রিত রাজতন্ত্রের পক্ষ সমর্থন করেন। ফলে জনগণের মতামতের উপর গুরুত্বারোপ করে জনগণ যে সর্বভৌম তার প্রতি লক স্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। অন্য কথায় তিনি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যাবস্থার ভিত্তি সুদৃঢ় করেন তাঁর সামাজিক চুক্তি মতবাদের মাধ্যমে।

রুশোর সামাজিক চুক্তি মতবাদের মূলকথা 

সামাজিক চুক্তি মতবাদের অপর একজন উল্লেখযোগ্য প্রবক্তা হচ্ছেন ফরাসী দার্শনিক জ্যা জ্যাক রুশো । তিনি তাঁর প্রসিদ্ধ 'The Social Contrac" গ্রন্থে সামাজিক চুক্তি ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করেন। তবে এক্ষেত্রে তিনি তাঁর পূর্ববর্তী দার্শনিক হসের চেয়ে লকের মতামতের সঙ্গে অধিক পরিমাণে একাত্মতা ঘোষণা করেন।

রুশোর প্রকৃতির রাজ্য কেমন ছিল?

রুশো সামাজিক চুক্তির প্রকৃতি বর্ণনা করার পূর্বে "প্রকৃতির রাজ্যের" চিত্র তুলে ধরেন। তাঁর মতে প্রকৃতির রাজ্যের মানুষ সুখে-শান্তিতে বসবাস করত। তাদের জীবন ছিল প্রাণবন্ত ও ছন্দময় মানুষের মাঝে ছিল না কোন হিংসা-দ্বেষ ও দ্বন্দ্ব কলহ। অবাধ, অনিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা ভোগের মাধ্যমে তারা সুষ্ঠ সুন্দর ও নির্মল জীবন গড়ে তুলেছিল।

রুশোর মানব প্রকৃতি কেমন ছিল?

অবশ্য ধীরে ধরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি অর্জন ও ভোগ দখলের প্রণতা মানুষের মধ্যে দেখা দিল। এতেকরে তাদের মধ্যে কলহ ও দ্বন্দ্ব-বিরোধের সৃষ্টি হয়। এ কলহ ও দ্বন্দ্ব বিরোধপূর্ণ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ লাভের জন্য জনগণ নিজেদের মধ্যে পরস্পর এক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। চুক্তির ফলে সকলে কোন শাসক বা শাসকগোষ্ঠীর হাতে নয়, বরং সামগ্রিকভবে সামাজের হাতে নিজেদের শাসন করার অধিকার অর্পণ করল। অবশেষে তারা সকলে একটি সাধারণ ইচ্ছার অধীনস্থ হল।

রুশোর মতে, এই সাধারণ ইচ্ছা হলো সার্বভৌম। তিনি মানুষের ইচ্ছাকে সাময়িক ইচ্ছা ( Actual Will) এবং 'প্রকৃত 'ইচ্ছা' (Real will) এ দু'ভাগে ভাগ করেছেন। তাঁর মতে, 'সাময়িক ইচ্ছা' মানুষের স্বার্থান্বেষী ইচ্ছা আর প্রকৃত ইচ্ছা' কল্যাণকর ইচ্ছা। রুশো সাধারণ ইচ্ছাকে জনগণের প্রকৃত ইচ্ছার সমষ্টি বলে বর্ণনা করেছেন। সাধারণ ইচ্ছা সর্বদাই জনবল্যাণে নিয়োজিত। এটি কোন ব্যক্তি বিশেষের মুষ্টিমেয় ব্যক্তিবর্গের কিংবা অধিকাংশ জনগোষ্ঠির মতও হতে পারে যদি এর উদ্দেশ হয় জনকল্যাণ সাধন।

এভাবে রুশোর সামাজিক চুক্তি মতবাদ এক রাষ্ট্রসংস্থার অধীনে মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতাকে সুসংহত রূপ দান করে। তাঁর এ চুক্তির ফলে যে সার্বভৌম ক্ষমতার সৃষ্টি হয় তা প্রকৃতপক্ষে জনগণের সার্বভৌমত্ব । প্রসঙ্গত উল্লেখ যোগ্য যে, রুশোর এ মতবাদ ১৭৮৯ সালের ফরাসী বিপ্লবের প্রতি সমর্থন যোগায়।

সামাজিক চুক্তি মতবাদের সমালোচনা

সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে যখন সামাজিক চুক্তি মতবাদ প্রথম প্রনত্ত হয় তখন তা যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকে এ মতবাদ তার গুরুত্ব হারাতে থাকে। সমালোচকদের মতে, এ মতবাদ রাষ্ট্রের উৎপত্তির যে ব্যাখ্যা দিয়েছে তা নিতান্তই কাল্পনিক ও ইতিহাসবিরুদ্ধ। প্রকৃতপক্ষে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সামাজিক চুক্তি মতবাদ সমালোচিত হয়েছে। সমালোচনাগুলো নিরূপ:

• সামাজিক চুক্তি অ-ঐতিহাসিক। রাষ্ট্রের উৎপত্তি খুঁজতে গিয়ে এ মতবাদ চুক্তির উপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে। কিন্তু তা কোন সঠিক ঐতিহাসিক তথ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। ইতিহাসে এমন কোন প্রমাণ নেই যা থেকে এ ধারণা জন্মায় যে রাষ্ট্র চুক্তির ফল।

• এ মতবাদ কাল্পনিক। বাস্তবতার সঙ্গে এর কোন মিল পাওয়া যায় না। 'প্রকৃতির রাজ্যে' মানুষের বসবাস করা নিছক কল্পনা মাত্র। এছাড়া চুক্তির মত সূক্ষ্ম ধারণা মানুষের কখনো হতে পারে না।

• এ মতবাদ অযৌক্তিক। 'প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ সম্পূর্ণ স্বাধীন ছিল বলে এ মতবাদে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এটি নিতান্তই ভুল ধার না। 'প্রকৃতির রাজ্যে প্রাকৃতিক অধিকার আইন ও শৃঙ্খলার কথা চিন্তা করা অজ্ঞতারই পরিচয় বহন করে। তা ছাড়া যে জনগনের রাষ্ট্র সম্পর্কে কোন পূর্ব জ্ঞান ছিল না, তরা হঠাৎ করে রাষ্ট্র গঠনে প্রব এমনভাবনা তা নিতান্তই অযৌক্তিক বলে মনে হয়।

• এ মতবাদ ক্ষণস্থায়ী। চুক্তির মাধ্যমে সৃষ্ট রাষ্ট্রের শর্ত কেবলমাত্র চুক্তি যারা সম্পাদন করেছেন তাদের উপরই বর্তাবে। চুক্তি সম্পাদনকারীদের মৃত্যুর পর তাদের পরবর্তী বংশধরদের উপর চুক্তির কার্যকারিত থাকতে পারে না। কিন্তু রাষ্ট্রের বেলায় এ বিধান আরোপ করা সম্ভব নয়, কেননা রাষ্ট্র একটি অপরিবর্তিত ও চিরস্থায়ী সংস্থা। চুক্তি অবসানের সাথে সাথে রাষ্ট্রেরও অবসান হবে এ ধারণা সম্পূর্ণরূপে ভ্রান্ত। রাষ্ট্র কোন ধরনের কৃত্রিম সৃষ্টি হতে পারে না।

• এ মতবাদ বিকৃত মতবাদ। এটি সত্যকে বিকৃত করার শামিল। মানুষ সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব। কিন্তু সামাজিক চুক্তি মতবাদ মানুষকে সামাজিক জীব বলে গণ্য না করে তাকে একধরনের বন্য জীবের সমতুল্য বলে ধরে নিয়েছে। এদিক থেকে বিচার করেই ভল্টেয়ার রুশোর চুক্তি মতবাদের ধারণাকে 'বন্য' বলে অভিহিত করেছেন।

সামাজিক চুক্তি মতবাদের গুরুত্ব ও প্রভাব

রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত সামাজিক চুক্তি মতবাদ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সমালোচিত হওয়া সত্ত্বেও এ মতবাদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও প্রভাবকে অস্বীকার করা যায় না। স্বৈরতন্ত্রের যুগে এ মতবাদ গণতান্ত্রিক ধারণা বিকাশে সবিশেষ সহায়তা করেছে। জনগণের সমর্থনই রাষ্ট্রশক্তির প্রকৃত উৎস এ মতবাদ তা ধারণ করে। প্রকৃতপক্ষে সামাজিক চুক্তি মতবাদ সমগ্র বিশ্বকে ঐশ্বরিক ও বলপ্রয়োগ মতবাদের খারাপ প্রভাব থেকে রক্ষা করেছে।

সামাজিক চুক্তি মতবাদ জনগণের সার্বভৌমত্বের উপর গুরুত্ব আরোপ করে। সার্বভৌম ক্ষমতার বিকাশ সাধনে এ মতবাদ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। এ মতবাদের মাধ্যমে জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস-এ ধারণা লাভ করা যায়। সর্বোপরি সামাজিক চুক্তি মতবাদ অষ্টাদশ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপ ও আমেরিকার রাজনৈতিক দর্শনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। ফরাসী বিপ্লব এবং আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামের পেছনে এ মতবাদ প্রেরণা যুগিয়েছে।

শেষকথা

সামাজিক চুক্তি মতবাদীদের মতে চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে। ঈশ্বরের ইচ্ছা বা কোনরূপ দৈহিক শক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রের উৎপত্তি ঘটে নি। রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পূর্বে মানুষ 'প্রকৃতির রাজ্যে বসবাস করত। কিন্তু সেখানে তাদের জীবনের কোন নিরাপত্তা ছিল না। ছিল না কোন সার্বভৌম শাসক। আর সেজন্য মানুষ চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে সার্বভৌম শাসকের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করতে সচেষ্ট হয়। সপ্তদশ শতাব্দীর ইংরেজ দার্শনিক হবস লক এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর ফরাসী দার্শনিক রুশোর হাতে এই সামাজিক চুক্তি মতবাদ এক চূড়ান্ত রূপ লাভ করে।

পূর্ববর্তী পরবর্তী
No Comment
মন্তব্য করুন
comment url