বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা উল্লেখ কর।
বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। শাসনব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলের ভূমিকা অনন্য। বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই দলীয় ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকলেও দলীয় ব্যবস্থা একরূপ নয়। তবে দলীয় ব্যবস্থার প্রকৃতি ভিন্ন হলেও অধিকাংশ রাষ্ট্রের আইনসভায় রাজনৈতিক দল বেশ কিছু আধুনিক দায়িত্ব বা ভূমিকা পালন করে থাকে বাংলাদেশের আইনসভায়ও রাজনৈতিক দল বেশকিছু ভূমিকা পালন করে থাকে।
বাংলাদেশের আইনসভায় রাজনৈতিক দলের ভূমিকা: বাংলাদেশের আইনসভায় রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্নভাবে কিছু আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব পালন করে। রাজনৈতিক দলকে সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতি অনুসরণ করে আইনসভায় ভূমিকা রাখতে হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা ও সদাচরণের উপর আইনসভার কার্যকাপের মেয়াদ বহুলাংশে নির্ভর করে। জনকল্যাণমূলক কার্যাবলির বৃদ্ধির সাথে সাথে আইনসভায় রাজনৈতিক দলের ভূমিকা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিম্নে আইনসভায় রাজনৈতিক দলের আনুষ্ঠানিক ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. আলোচনামূলক কাজ অংশগ্রহণ : রাজনৈতিক দল আইনসভাও আলাপ-আলোচনা ও বিতর্কমূলক কাজে অংশগ্রহণ করে। সাধারণত দেশের অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্র সংক্রান্ত বিষয়ে আইনসভা বিতর্ক ও আলাপ-আলোচনামূলক অধিবেশনের আয়োজন করে থাকে। সরকারি বিল, বেসরকারি বিল, আইনসভায় প্রদত্ত রাষ্ট্রপ্রধানের বাণী ইত্যাদির উপর আইনসভায় বিতর্ক ও আলোচনা চলতে থাকে। বিরোধী দলের সদস্যগণ সরকারের বিভিন্ন নীতি ও কাজের গঠনমূলক সমালোচনা করে আইনসভাকে জীবন্ত ও প্রাণবন্ত করে রাখে। রাজনৈতিক দল আইনসভায় যে বিতর্ক ও আলোচনা করে সেগুলো বেতার, টেলিভিশন, সংবাদপত্র প্রভৃতি গণসংযোগের মাধ্যমগুলোতে প্রচারিত হয়। যা দেশের জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতে সাহায্য করে।
২. আইনসভায় উপস্থিতি : রাজনৈতিক দলের সকল সদস্য আইনসভার প্রত্যেক অধিবেশনে নিয়মিত উপস্থিত থাকেন। আইনসভায় সরকারি দল ও বিরোধী দলের সদস্যদের উপস্থিতির ফলে বিভিন্ন কার্যক্রমে গতিশীলতা হয়। এছাড়া আইনসভায় রাজনৈতিক দলের সদস্যদের উপস্থিতির কারণে কার্য পরিচালনায় কোনো ধরনের অসুবিধার সৃষ্টি হয় না। কেননা বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ন্যূনতম ৬০ জন সদস্যদের উপস্থিতি প্রয়োজন। তাই আইনসভার সদস্যদের সক্রিয় উপস্থিতি ও আইন প্রণয়নে অংশগ্রহণের উপর একটি দেশের সাফল্য নির্ভরশীল।
৩. সরকার গঠন : সাধারণত নির্বাচনের পর যে দল আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে, সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী। আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতাকেই রাষ্ট্রপ্রধান প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করেন। তারে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপ্রধান অন্যান্য মন্ত্রীদের নিয়োগ দেন। তবে কোনো কোনো রাষ্ট্রে দলীয় সদস্যের বাইরের কিছু ব্যক্তিকে মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেয়ারও বিধান আছে। রাজনৈতিক দল নির্বাচনের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করে দলীয় নীতি ও আদর্শ অনুযায়ী সরকার পরিচালনা করে থাকে। রাজনৈতিক দল শাসন কার্য পরিচালনার সময় জনগণকে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে তৎপর থাকে।
৪. সরকারের স্থায়িত্ব: সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় সরকারের স্থায়িত্বের ক্ষেত্রে দলীয় ব্যবস্থার ভূমিকা অপরিসীম। বর্তমানে অধিকাংশ রাষ্ট্রে দলীয় প্রথার ভিত্তিতে আইনসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। আইনসভার নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলই সরকার গঠন ও পরিচালনা করে থাকে। তাই সরকারের নীতি ও কার্যাবলির পিছনে সবসময় আইনসভার অধিকাংশ সদস্যের। সমর্থন থাকে। এ ধরনের সরকার স্থায়ী, সুদৃঢ় ও শক্তিশালী হয়। তাই সরকার জনকল্যাণ সাধনে পরিপূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করতে পারে।
৫. সরকারের নিয়ন্ত্রণ: আইনসভায় দলীয় সদস্যগণ মন্ত্রিগণের দায়িত্বশীলতা নিশ্চিতকরণে ভূমিকা পালন করে। মন্ত্রিগণ তাঁদের সম্পাদিত নীতি ও কার্যাবলির জন্য ব্যক্তিগতভাবে ও যৌথভাবে আইনসভার নিকট জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকেন। আইনসভার সদস্যগণ যতদিন মন্ত্রিসভার উপর আস্থা রাখে ততদিন মন্ত্রিসভার সদস্যগণ ক্ষমতাসীন থাকেন। আইনসভার দলীয় সদস্যদের আস্থা হারালে মন্ত্রিসভার সদস্যদের পদত্যাগ করতে হয়।
৬. আইন প্রণয়নের ভূমিকা পালন : রাজনৈতিক দল আইনসভায় আইন প্রণয়নে ভূমিকা পালন করে থাকে রাজনৈতিক দলের সদস্য কর্তৃক প্রণীত আইনের দ্বারা শাসনকার্য | পরিচালিত হয়। সংবিধানের নিয়মানুযায়ী আইনসভায় দলীয় সদস্যগণ যে কোনো নতুন আইন তৈরি, প্রচলিত আইনের রদবদল এবং অপ্রয়োজনীয় আইন বাতিল করতে পারে। দলীয় সদস্যগণ দেশের সংবিধানের সাথে সংগতি রক্ষা করে এবং জনমতের গতিপ্রকৃতির দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে নতুন আইন প্রণয়নে ভূমিকা পালন করে থাকেন।
৭. নীতি ও আদর্শ প্রচার : প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের সদস্য আইনসভায় বক্তৃতাকালে তাদের দলীয় নীতি ও আদর্শ প্রচার করে থাকেন। বিভিন্ন দলের বক্তব্য শুনে জনগণ সেসব দলের নীতি ও আদর্শ সম্পর্কে অবহিত হতে পারে। রাজনৈতিক দল নিজ নিজ নীতি ও আদর্শ প্রচারের মাধ্যমে জনপ্রিয়তা লাভের চেষ্টা করে। এভাবে দলসমূহ আদর্শের প্রচারক হিসেবে কাজ করে।
৮. রাজনৈতিক শিক্ষা বিস্তার : রাজনৈতিক দলগুলো আইনসভায় জনগণের রাজনৈতিক শিক্ষা ও চেতনার বিস্তার ঘটাতে ভূমিকা রাখে। আইনসভা হলো দলীয় সদস্যের রাজনৈতিক শিক্ষা কেন্দ্র। জনগণকে রাজনীতি সচেতন করা ও তাদেরকে কাজে উদ্যমশীল করা রাজনেতিক দলের কাজ। দলগুলো তাদের দলীয় কর্মসূচি ব্যাখ্যার পাশাপাশি অন্যান্য দলের কর্মসূচিকে সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করার মাধ্যমে জনগণের মধ্য শিক্ষাবিস্তার ঘটায়।
৯. আইন ও শাসন বিভাগের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় : রাজনৈতিক দল আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের মধ্যে সুসম্পর্ক রাখতে সহায়তা করে। সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় থাকে। দলীয় ব্যবস্থার মাধ্যমে উভয় বিভাগের মধ্যে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশের আইনসভায় রাজনৈতিক দলের ভূমিকা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। রাজনৈতিক দল আইনসভায় তার বহুবিধ ভূমিকা পালনের মাধ্যমে সরকার ব্যবস্থাকে সচল রাখে। রাজনৈতিক দল ছাড়া সংসদীয় গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার কথা চিন্তাই করা যায় না। এছাড়া দেশের সকল প্রশাসনিক কার্যক্রম আইনসভার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলের সদস্যরাই পরিচালনা করে থাকেন। তাই রাজনৈতিক দলকে আইনসভার প্রাণ হিসেবে অভিহিত করা হয়।