আন্তর্জাতিক আইন বলতে কি বুঝ? আন্তর্জাতিক আইনের সংজ্ঞা, উৎস, প্রকার, পরিধি

বর্তমান বিশ্ব নিঃসঙ্গবাদে বিশ্বাসী নয় বরং বিভিন্ন রাষ্ট্র আজ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত ও নির্ভরশীল। এই পারস্পরিক সম্পর্ক ও নির্ভরশীলতা যে সকল বিধি-বিধানের মাধ্যমে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয় সেগুলো হচ্ছে আন্তর্জাতিক আইন। আন্তর্জাতিক আইনের উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে রোমান আইন, সন্ধি ও চুক্তি, প্রথা ও রীতিনীতি, আইনজ্ঞদের বক্তব্য, কূটনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনারয়কদের অভিমত এবং সর্বোপরি জাতিসংঘের সিদ্ধান্তসমূহ।

আন্তর্জাতিক আইন

বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র যে সব বিধি-বিধানের মাধ্যমে তাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বজায় রাখে সেগুলো হচ্ছে আন্তর্জাতিক আইন। এসব আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্রগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। 

টি.জে লরেন্স (T. J. Lawrence)-এর মতে, “আন্তর্জাতিক আইন হচ্ছে সেসকল বিধান যেগুলো সভ্য রাষ্ট্রগুলোর কর্মকাণ্ডের মধ্যে পারস্পরিক লেনদেন নির্ধারণ করে।

ওপেনহাইম (Oppenheim) আন্তর্জাতিক আইনকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে লিখেছেন "যেসব চিরাচরিত সামাজিক বিধানকে সভা রাষ্ট্রগুলো তাদের নিজেদের মধ্যকার সম্পর্ক বজায় রাখার ব্যাপারে বৈধভাবে অবশ্য পালনীয় বলে মনে করে সেগুলোকে আন্তর্জাতিক আইন বলে অভিহিত করা হয়।” 

অধ্যাপক হুইটন (Wheaton) এর মতে, “স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর সমাজ ব্যবস্থার প্রকৃতি এবং উক্ত সমাজ যেসব যুক্তিবোধসজ্ঞাত ধারণা তথা ন্যায়বিচারের ধারণা থেকে উদ্ভূত সেগুলো পরিচালনার জন্য নির্ধারিত বিধিবিধানের সমষ্টি হচ্ছে আন্তর্জাতিক আইন। 

আবার জোসেফ ফ্রাংকেলের (Joseph Frankel) কথায় বলতে গেলে বলতে হয় যে, “আন্তর্জাতিক আইন রাষ্ট্রগুলোর উপর নয় বরং রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে কার্যকরী আইন।”

আন্তর্জাতিক আইনের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য এই যে, এ আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে তেমন কোন কার্যকর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় না। এর প্রধান কারণ হলো রাষ্ট্রগুলো যথার্থভাবেই সার্বভৌম, কাজেই এদের উপর কোন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ থাকতে পারে না যাকে আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কিন্তু যদি এমন কেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ থাকে তবে রাষ্ট্রগুলোর সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ হয় তবে বর্তমান বিশ্বে অর্থনৈতিক অবরোধের মাধ্যমে বিভিন্ন রকম নিয়ন্ত্রণ আনা সম্ভব হচ্ছে। এই অসঙ্গতি দূর করা সম্ভব একমাত্র সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলো এবং আন্তর্জাতিক আইনের মধ্যে সামঞ্জস্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। বলা বাহুল্য, জাতিসংঘ কর্তৃক সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ফলে আন্তর্জাতিক আইন এখন উন্নততর হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক আইন কত প্রকার?

পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনায় আন্তর্জাতিক আইন তিন প্রকার। যথা: 
  1. শান্তিকালীন আইন
  2. যুদ্ধসংক্রান্ত আইন
  3. নিরপেক্ষতার আইন

আন্তর্জাতিক আইনের উৎস

আন্তর্জাতিক আইনের উদ্ভব ঘটেছে অতি সাম্প্রতিক কালে। প্রকৃতপক্ষে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অগ্রগতি ও বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক আইনেরও অগ্রগতি ও বিকাশ সাধিত হয়েছে। ইউরোপীয় সভ্যতা থেকে শুরু করে রোমান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা এবং সংস্কার যুগ পেরিয়ে তা আধুনিককালে অনুপ্রবেশ করেছে। এ বিবর্তন ধারায় আন্তর্জাতিক আইন একাধিক উৎস থেকে বিকশিত হয়। নিচে আন্তর্জাতিক আইনের কতিপয় উৎস সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:

রোমান আইন : আন্তর্জাতিক আইনের একটি উৎস হলো রোমান আইন। দুটো প্রধান উপায়ে রোমান আইন আন্তর্জাতিক আইনের মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। প্রথমত, জাতিগুলোর আইনের ধ্যান-ধারণা দ্বারা এবং দ্বিতীয়ত, আইনের চোখে সকলে সমান এ ধারণার মাধ্যমে। আন্তর্জাতিক আইনের এ ধারণা সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলো সমতা বর্ধন করতে বিশেষভাবে সহায়তা করেছে।

সন্ধি ও চুক্তি: যে কোন উদ্দেশ্যে সাধিত চুক্তি ও সন্ধিগুলো, (বাণিজ্যিক বা রাজনৈতিক ), আন্তর্জাতিক আইনের অপর একটি বিশেষ উৎস হিসেবে স্বীকৃত। এ ধরনের চুক্তি আন্তর্জাতিক আইনের বিকাশে প্রভূত পরিমাণে সাহায্য করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ওয়েস্টফালিয়া শান্তিচুক্তি (১৬৪৮), প্যারিস চুক্তি (১৭৬৩ ও ১৮৬৪), ভার্সাই চুক্তি (১৯১৯) এসবের উল্লেখ করা যায়।

প্রথা ও রীতিনীতি: প্রথা ও রীতিনীতিগুলো আন্তর্জাতিক আইনের অপর এক বিশেষ উৎস বলে স্বীকৃতি লাভ করেছে। প্রকৃত প্রস্তাবে আন্তর্জাতিক আইন প্রথা ভিত্তিক। প্রাচীন ও মধ্যযুগের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যকার লেনদেন ছিল মূলত প্রথা ও রীতিনীতির উপর ভিত্তিশীল। এসব প্রথা ও রীতিনীতি পরবর্তীকালে আইনের মর্যাদা অর্জন করে। 

পৌর আইন (রাষ্ট্রীয় আইন): বলা হয়ে থাকে যে, পৌর আইন তথা রাষ্ট্রীয় আইনের মধ্যে আন্তর্জাতিক আইনের বীজ নিহিত। প্রতিটি রাষ্ট্রের পৌর আইনের সংবিধি (Statutes) আন্তর্জাতিক আইনের অগ্রগতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নির্ণয়ে বিশেষ সহায়ক ভূমিকা পালন করে। নাগরিকতা অভিবাসন আইন, নিরপেক্ষতা ইত্যাদি সংক্রান্ত আইন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে।

প্রখ্যাত আইনজ্ঞদের বক্তব্য: অনেক প্রখ্যাত আইন বিশারদ আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কে বক্তব্য তুলে ধরেছেন। তাঁদের এসব বক্তব্য আন্তর্জাতিক আইনের উৎস হিসেবে কাজ করে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সমস্যা ও মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে তাঁদের বক্তব্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও প্রখ্যাত আইনজ্ঞদের লিখিত গ্রন্থ যেমন হুগো এসিয়াস ( Hugo Grotius ) -এর "On the Law of war and Peace" যা ১৬২৫ সালে প্রকাশিত হয় তা আন্তর্জাতিক আইনের তাত্ত্বিক ভিত্তি প্রদান করে। এছাড়াও রয়েছে পুফেনডরফ (Pufendorf) লিখিত "Law of Nature and Nations" এবং জায়ে নিজ (Zaibniz) বিরচিত Diplomatic Code of the Law of Nations" যা আন্তর্জাতিক আইনকে সুনির্দিষ্ট রূপ দিতে বিশেষভাবে সাহায্য করে।

যুদ্ধ ও কূটনীতির ইতিহাস : যুদ্ধের ইতিহাস, বিভিন্ন চুক্তি ও সন্ধি স্থাপন ইত্যাদি আন্তর্জাতিক কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক আইনের বিকাশ সাধনে উল্লেখযোগ্য সহায়তা করেছে। যুদ্ধকালীন সময়ে বিভিন্ন রাষ্ট্র কর্তৃক গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা আন্তর্জাতিক আইনের এক প্রধান উৎস হিসেবে স্বীকৃত হয়। উদাহরণস্বরূপ আটলান্টিক চার্টার (The Atlanic Charter) পটসড্যাম চুক্তি (The Potsdam Agreement)-এর উল্লেখ করা যায়।

কূটনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়কদের অভিমত: কুটনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়কদের লিখিত মতামতও আন্তর্জাতিক আইনের এক গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে কাজ করে। তাঁদের এসব মতামত সাধারণত স্টেট পেপার (State Paper) এবং বৈদেশিক অফিসে কূটনৈতিক পত্র লিখনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। এছাড়া রাষ্ট্রনায়কগণ তাদের বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক ও পররাষ্ট্র বিষাদির ক্ষেত্রে অমূল্য অভিমত ব্যক্ত করে থাকেন যা আন্তর্জাতিক আইন তৈরীর বেলায় পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করে।

জাতিসংঘের সিদ্ধান্তসমূহ: আধুনিক বিশ্বে জাতিসংঘ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এসব সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক আইনের রূপ ও প্রকৃতি অনেকাংশে নির্ধারণ করে থাকে। জাতিসংঘ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধানে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা, মধ্যস্থতা, সালিশী তৎপরতা এবং আন্তর্জাতিক আদালতনের রায় ও বিভিন্ন প্রস্তাব গ্রহণের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইনের গতি-প্রকৃতি নির্ধারণে সচেষ্ট হয়।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে আন্তর্জাতিক আইনের উৎস সম্পর্কে আমর সম্যক ধারণা লাভ করতে সক্ষম হই। বস্তুত: এসব উৎস আন্তর্জাতিক আইনকে এক বিশেষ মর্যাদা দান করেছে।

আন্তর্জাতিক আইনের পরিধি

আন্তর্জাতিক আইনের পরিধি বা বিষয়বস্তুর ব্যাপ্তি লক্ষ্য করার মত। অন্তর্জাতিক আইনের পরিধি সকল স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ণয় করে। এ আইন অনুসারে ছোট বড় সকল রাষ্ট্রই সমান মর্যাদা ভোগ করে। এ সমতার কারণেই এক রাষ্ট্র অপর রাষ্ট্রের উপর কোন নিজস্ব আইন ন্যায়সঙ্গতভাবে চাপিয়ে দিতে পারে না।

আন্তর্জাতিক আইনের পরিধি বা বিষয়বস্তুকে নিম্নোক্ত কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়:

• শান্তিকালীন সময়ে রাষ্ট্রগুলো কর্মকাণ্ড পরিচালনাকারী আইন।

• যুদ্ধ চলাকালে রাষ্ট্রগুলোর কর্মকাণ্ড পরিচালনাকারী আইন।

• নিরপেক্ষতার সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য আইন।

১. শান্তিকালীন সময়ে রাষ্ট্রগুলোর কর্মকাণ্ড পরিচালনাকারী আইনের মধ্যে বিভিন্ন রাষ্ট্রের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সমতার দায়িত্ব ও কর্তব্য, জাহাজ চলাচল সংক্রান্ত আইন, পররাষ্ট্র দপ্তরসমূহের কর্মকর্তাদের দায়িত্ব, কর্তব্য ও অধিকার কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের বিশেষ অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলোর সংগঠন ও কার্যপ্রণালী, সন্ধিস্থাপন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

২. যুদ্ধ চলাকালে যুদ্ধ আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন আন্তর্জাতিক আইনের অন্তর্ভুক্ত। যুদ্ধ ঘোষণা করা, যুদ্ধের শ্রেণীবিভাগ, জল ফুল ও অন্তরীক্ষে যুদ্ধের আইন ও রীতি নীতি, যুদ্ধোত্তর কালে যুদ্ধের প্রভাব, যুদ্ধবন্দীদের সঙ্গে আচরণ, যুদ্ধে বিষজনিত কোন গ্যাস বা জীবাণু ব্যবহার নিষিদ্ধ করা এবং বেসামরিক এলাকায় বোমা হামলা বা নিক্ষেপ না করা আন্তর্জাতিক আইনের অন্তর্ভুক্ত বিষয়।

৩. নিরপেক্ষতার সম্পর্ক বজায় রাখা সংক্রান্ত আইনের মধ্যে রয়েছে শত্রু আক্রান্ত রাষ্ট্রগুলোর প্রতি নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলোর দায়-দায়িত্ব, নিরপেক্ষ ব্যবসা-বাণিজ্য, বাণিজ্যিক ও অন্যান্য অবরোধ আরোপ করা।
পূর্ববর্তী পরবর্তী
No Comment
মন্তব্য করুন
comment url